১৫ জুন ছিল বিশ্ব বাবা দিবস। সারাদিন সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে বাবাদের নিয়ে অনেকে অনেক কিছু লিখেছেন। বাবাকে অনেকে তাদের জীবনের নায়ক (হিরো) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বছরের বাকি দিনগুলোতে বাবাকে নিয়ে আমরা ভাবি কিনা বা বাবার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করি কিনা সেটা ভিন্ন আলাপ। বাবা বা মাকে বছরের নির্দিষ্ট একটি দিন উৎসর্গ করার সংস্কৃতি একটি ভালো দিক। কারণ আধুনিক যুগে দেশে দেশে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। আর তাই ক্রমবর্ধমান ব্যক্তিবাদী ও বস্তুবাদী সমাজে বাবা ও মায়েরা আগের মতো সন্তানদের কাছ থেকে ভালোবাসা, যত্ন ও সম্মান পান না। বাবা ও মা দিবস যদি ভালো কিছু ভাবতে ও করতে শেখায় তবে সেটা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মা ও তাদের অবদান নিয়ে যতটা কথা ও আলোচনা হয় বাবাকে নিয়ে ঠিক ততটা হয় না। কারণটা সবারই জানা। মা সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন, লালন-পালনে প্রত্যক্ষভাবে সবচেয়ে বেশি জড়িত থাকেন। মায়েরা বরাররই সন্তানের জীবনে সম্মুখ যোদ্ধা যেখানে বাবার ভূমিকা অনেকটা নীরবে নিভৃতে। জ্ঞানী লোকের মতে, মা হলেন পরিবারের হৃদয় আর বাবা হলেন মস্তিষ্ক। পরিবারে দুজনের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মানব প্রকৃতির নিয়মে মস্তিষ্কের চেয়ে হৃদয় বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। তাই বাবা দিবস একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনটি হতে পারে আমাদের জীবনে বাবার অবদানকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করার উপলক্ষ্য।
আমাদের তিন সহোদর ভাইয়ের বাবা অতুল বার্নার্ড রোজারিও কোন নায়ক বা মহামানব নন, তিনি একজন হার না মানা যোদ্ধা এবং দোষ-গুণের সমন্বয়ে একজন নিপাট ভালো মানুষ ও আদর্শ পিতা। ছোটবেলা থেকে খুব কাছ থেকে দেখা বাবা একজন ধার্মিক, সৎ, পরিশ্রমী, নীতিবান, স্বল্পভাষী, নির্লোভ ও নির্বিবাদী মানুষ। পারিবারিক ও গৃহস্থালী নানা কাজেও বাবা বেশ পটু। অন্য অনেকের মতো তিনি স্বভাবগতভাবে সামাজিক নন, তার পৃথিবী হলো তার পরিবার ও কর্মক্ষেত্র। বাবা ক্লাসিক সিনেমা ও গান ভালোবাসতেন। এক সময় তার কাছে বিখ্যাত সব শিল্পীদের অডিও ক্যাসেটের সংগ্রহ ছিল। এখন তার অখন্ড অবসর সময় কাটে টিভিতে নানা প্রাণীবৈচিত্র্য বিষয়ক ডকুমেন্টারি ও ভারতীয় বাংলা সিরিয়াল দেখে। জীবনের পথ পাড়ি দিতে দিতে তিনি সাতটি দশক পেরিয়ে এসেছেন। তার জীবনের সিংহভাগ কেটেছে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ছোট সাতানীপাড়া গ্রামের গজাইরাগো বাড়িতে। বর্তমানে আমাদের মায়ের সাথে সেখানেই বসবাস করছেন। বাবা-মায়ের বিবাহিত জীবনও চার দশকের বেশি।
আমার ঠাকুরদা পলিন আগষ্টিন রোজারিও ও ঠাকুরমা তেরেজা রিরেরুর চার ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে বাবার অবস্থান সপ্তম। দাদু পলিন রোজারিও ছিলেন তার সময়ে সাধু আন্তনীর পালাগানের (ঠাকুরের গীত) প্রখ্যাত শিল্পী এবং দলের প্রধান বা ওস্তাদ। দাদুর পদাঙ্ক অনুসরণ আমার বাবাও একজন ভালো কৃষক হয়েছেন যদিও তার পৈতৃক কৃষিজমি যৎসামান্য। মধ্যপ্রাচ্যে কয়েক বছর এবং ঢাকা ও গাজীপুরে কিছুদিন চাকুরির সময় বাদ দিলে কৃষিকাজ করেই বাবা সংসার চালিয়েছেন। বাবা কঠোর পরিশ্রমী হলেও সামান্য জমি থেকে সামান্য আয় হতো, তাই পরিবারকে দীর্ঘদিন দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে।
বয়স ও ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই বাবার পক্ষে আজ কঠোর পরিশ্রমের কৃষিকাজ সম্ভব হচ্ছে না। শারীরিক পরিশ্রমের কোন কাজই আজ তার পক্ষে আজ অসম্ভব। আমরা তিন ভাই ছোটবেলা বাবাকে কৃষিকাজে নানাভাবে সহায়তা করেছি। কিন্তু বড় হয়ে পড়াশুনা শেষ করে একেকজন একেক পেশায় নিযুক্ত হয়েছি। সুতরাং পৈতৃক পেশা কৃষিকাজে বাস্তবসম্মতভাবেই নিজেদেরকে নিযুক্ত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আশির দশকে বাবা কিছুদিন ঢাকায় কাপড়ের দোকানে কাজ করেছেন। এরপরে চার বছর কুয়েতে চাকুরি করেছেন। কৃষিকাজের পাশাপাশি বাড়িতে কাপড়ের ব্যবসা, নানারকম সবজি ও ফলের ব্যবসা করে ভাগ্যান্বেষণের চেষ্টা করেছেন। এতো সংগ্রামের পরেও নানা কারণে তিনি ভাগ্যের তেমন উন্নতি করতে পারেন নি। এর পেছনে দুর্ভাগ্য ছাড়াও ছিল মানুষের অবহেলা ও প্রতারণা। বাবা কখনো কোন কথা বা কাজের মাধ্যমে তার প্রতি অন্যায়ের শোধবোধ করেন নি। কিন্তু বাবাকে যারা ঠকিয়েছেন তারা জীবনের বিভিন্ন সময়ে প্রকৃতির নিয়মে শাস্তি ভোগ করেছেন।
জীবনে নানাভাবে চেষ্টা করেও বেশি উন্নতি করতে পারেন নি বলেই মনে হয় বাবা নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রাখতেন, তার কষ্ট ও অভিমানগুলো নিজের মধ্যেই চেপে রাখতেন। তবুও যতটা পেরেছেন নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করার প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। এ কারণে বাবার সাথে সম্পর্কটা ততটা গভীর হয় নি যতটা মায়ের সাথে। বাবা যেমন সৎ তেমনি কড়া মানুষ ছিলেন, তাই তাকে বেশ ভয় পেতাম। সন্তানদের জন্য অনেক কিছু না করতে পারলেও তাদেরকে ভালোভাবে মানুষ করতে চেষ্টার ত্রুটি করেন নি। আদর করতেন নীরবে কিন্তু শাসন করতেন সরবে। পড়াশুনায় গুরুত্ব দিতে বলতেন সব সময় এবং জীবনে বড় হতে হবে একথা মনে করিয়ে দিতেন। বাবার নানান ভালো গুণের কিছুটা হলেও আমরা পেয়েছি। এটাই হয়তো আমাদের জীবনে বাবার সবচেয়ে বড় অবদান।
বাবার সাথে স্মৃতির ভান্ডার অফুরন্ত। মনে পড়ে ছোটবেলা বাবা বাজার বা হাটে গেলে আমরা অপেক্ষা করতাম কখন ফিরবেন। কারণ বাবা সব সময় মজার কিছু আনতেন যখন যা পাওয়া যেতো - কখনো বাদাম, মিঠাই, আখ, কাঁঠাল, শন পাপড়ি, বাতাসা বা মুড়ুলী। কখনো কখনো ইলিশ মাছ আনতেন, আর সেদিন ছিল একটা উৎসবের মতো। বাবার সাথে খালে ও বিলে ঠেলা জালি দিয়ে মাছ ধরতে যেতাম, ভালো মাছ পেলে খুবই আনন্দ পেতাম। অনেক দূরের বেলাই বিলে ধানক্ষেতে কাজের সময় বাবার জন্য ভাত, তরকারি ও পানি নিয়ে যেতাম, আর বাবার সাথে ক্ষেতের আইলে বসে খেতাম। সামান্য ভাত-মাছ তখন অমৃতের মতো মনে হতো। নলছাটার ঐতিহ্যবাহী কড়ি পূজার মেলায় বাবার সাথে অনেক বার গিয়েছি ও দারুণ উপভোগ করেছি। মেলা থেকে বাঁশি, বন্দুক ও খেলনা কিনে নানা নিমকি, মুড়ুলী প্রভৃতি খেতে খেতে বাড়ি ফেরা ছিল এক রোমাঞ্চকর শৈশবের অংশ। সম্ভবত ১৯৯২-৯৩ সালে প্রথমবারের মতো আড়িখোলা স্টেশন থেকে কমলাপুর লোকাল ট্রেনে চড়ে ঢাকা এসেছিলাম বাবার সাথে। সে সময় পুরান ঢাকার লক্ষীবাজার, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল এবং মতিঝিল শাপলা চত্ত্বর ভ্রমণের স্মৃতি মনে পড়ে। এরকম অনেক স্মৃতি আজো চির সবুজ।
বাবার জীবন সংগ্রাম আমাদের জন্য সব সময়ের অনুপ্রেরণা। বাবা ও মা অনেক কষ্ট করে আমাদের মানুষ করেছেন বলেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েও আমরা অতীতকে ভুলে যাই নি। বাবা ও মায়ের সুশিক্ষাকে গ্রহণ করে চেষ্টা করছি ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য। আমাদের বাবা ও মায়ের দীর্ঘ জীবন কষ্টের ও সংগ্রামের ছিল বলেই আমরা শেষ বয়সে তাদেরকে জীবনকে তুলনামূলকভাবে সহজ করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি ও যাবো। গত বছর বাবা বেশ কিছু জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরিবারের সকলের আন্তরিক ও কঠোর প্রচেষ্টায় চিকিৎসা শেষে বাবা অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। বর্তমানে কিছু ছোটখাট সমস্যা থাকলেও বাবা বেশ ভালো আছেন মায়ের তত্ত্বাবধানে। বাস্তব কারণে শহরবাসী হলেও আমরা প্রতি মাসে তাদেরকে দেখতে যাই। বড়দিন ও ইস্টারের ছুটিতে তাদের সাথে সময় কাটাই। আমার বয়সে এসে আশেপাশের অনেকে বাবা ও মা হারা হয়ে গেছে। সে অর্থে আমরা ভাগ্যবান আমাদের বাবা ও মা আজো জীবিত। এজন্য আমরা ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ। বাবা ও মা জীবিত অবস্থায় তাদের মূল্যায়ন করা উচিত, নাহলে তাদের অবর্তমানে তা করা হলে তা লোক দেখানো মনে হতে পারে।
কথায় বলে, বাবা ও মা না হলে সত্যিকার অর্থে বাবা-মায়ের গুরুত্ব বোঝা সম্ভব হয় না। সেজন্য নিজে পিতা হয়েছি বলেই বুঝতে পারি সন্তানের জীবনে বাবা ও মায়ের অবদান কতো অসামান্য। প্রার্থনা করি ঈশ্বর আমাদের বাবাসহ পৃথিবীর সকল সংগ্রামী বাবাকে অনেক আশীর্বাদ করুন এবং ভালো রাখুন সর্বদা।
১৫ জুন, ২০২৫, ঢাকা