Oct 14, 2017

শ্রদ্ধাঞ্জ‌লি: ফাদার বেঞ্জা‌মিন কস্তা, সিএস‌সি (১৯৪২-২০১৭)

ফাদার বেঞ্জা‌মিন কস্তা, সিএস‌সি (Photo: Stephan Uttom)

২০০১ খ্রিস্টা‌ব্দের জুলাই মা‌সে মাধ্য‌মি‌কের গ‌ন্ডি পে‌রি‌য়ে উচ্চ মাধ্য‌মি‌কে পড়‌তে ঢাকায় আ‌সি। সে সময় অব‌ধি গ্রাম ও মফ:স্ব‌লের আ‌লো-বাতা‌সে বড় হওয়া ও সদ্য কৈ‌শোরের চৌকাঠ মাড়া‌নো দুরুদুরু ব‌ক্ষের একজন ছে‌লের জন্য ঢাকার মতো ব্যস্ত ও বিপুলায়তন নগরী‌তে আসাটাই  এক অ‌বিস্মরণীয় ঘটনা। তদুপ‌রি দেশ‌সেরা নটর ডেম ক‌লে‌জের স্বপ্ন ছিল দু‌চো‌খে, য‌দিও মাধ্য‌মি‌কের রেজাল্ট ছিল নিতান্তই সাদামাটা। এখা‌নেই দেখা পাই  একজন পক্ক‌কেশ জ্ঞানী কিন্তু নিতান্তই সাধা‌সি‌ধে সন্ন্যাসব্রতী যাজকের। তি‌নি আর কেউ নন ফাদার বেঞ্জা‌মিন কস্তা, নটর ডেম ক‌লে‌জের অধ্যক্ষ।
দুই বছ‌রের ইন্টার‌মি‌ডি‌য়েট সেশ‌নে সময় দ্রুত চ‌লে যায়। ক‌লে‌জের বি‌ভিন্ন প্রোগ্রা‌মে তা‌কে বহুবার দে‌খে‌ছি, তার জ্ঞানগর্ভ অ‌নেক কথা শু‌নে‌ছি কিন্তু তার ক্লা‌শের ছাত্র হবার সৌভাগ্য হ‌য়ে ও‌ঠে নি। নিরহংকার মানুষ‌টি‌কে সব সময় নম্রতার ভা‌রে মাথা নুই‌য়ে থাক‌তে দে‌খে‌ছি। তা‌কে দে‌খে বোঝার উপায় ‌নেই তি‌নি দেশখ্যাত এ ক‌লে‌জের অধ্যক্ষ। বরং ম‌নে হ‌তো তি‌নি অন্য দশজন শিক্ষ‌কের একজন অথবা বিনম্র স‌হনশীল একজন পিতা যি‌নি তার সন্তান‌দের কল্যাণ, মেধা-মন‌নের বিকা‌শে আপ্রাণ প্র‌চেষ্টায় ব্রতী। এত নামী প্র‌তিষ্ঠা‌নের অধ্যক্ষ হ‌লেও তার নি‌জের কোন গা‌ড়ি ছিল গা‌ড়ি না।তি‌নি সাধারণ মানু‌ষের ম‌তোই গণপ‌রিবহ‌নে যাতায়াত কর‌তেন। শুনে‌ছিলাম প‌রে তার কষ্ট দে‌খে ক‌লে‌জের শিক্ষক ও স্টাফরা মি‌লে তা‌কে গা‌ড়ি কি‌নে দি‌য়ে‌ছি‌লেন।
২০০৪ খ্রিস্টা‌ব্দে যখন ডি‌গ্রি কো‌র্সে ভ‌র্তি হই তখন তি‌নি‌ কিছু‌দিন আমা‌দের ইং‌রে‌জি ক্লাশ নেন। তখন তা‌কে কা‌ছে থে‌কে দেখার ও অ‌নেক কিছু শেখার সু‌যোগ পাই। য‌দিও তি‌নি ইন্টার‌মি‌ডি‌য়েট শ্রেণী‌তে বাংলা পড়া‌তেন, কিন্তু ইং‌রে‌জি ভাষায় তার অসামান্য দক্ষতা ছিল। তিনি ইং‌রে‌জি ব্যাকরণ ও উচ্চারণ বিদ্যা এমন সরলভা‌বে পড়া‌তেন ম‌নে হ‌তো তি‌নি ইং‌রে‌জি ভাষাভাষী কোন দে‌শের মানুষ। সকল ক্লা‌সেই  আ‌মি প্রচুর প্রশ্ন করতাম, কারণ জ্ঞানার্জ‌নের তীব্র আকাঙ্খা ছিল। আমার শিক্ষকদের কেউ কেউ এ স্বভা‌বের কার‌ণে বিরক্ত হ‌তেন, কখ‌নো কখ‌নো  না‌জেহাল হ‌তেন কারণ সব প্র‌শ্নের উত্তর তা‌দের জানা ছিল না। কিন্তু ফাদার বেঞ্জা‌মিন কখ‌নো বিরক্ত হ‌তেন না, না‌জেহাল হওয়া তো দূ‌রের কথা। তার কা‌ছে সব প্র‌শ্নের উত্তর জমা থাক‌তো। ক্লাশ শে‌ষে ক‌য়েকবার তি‌নি আমা‌কে ব‌লে‌ছি‌লেন, “আজ তো সময় পেলাম না ভা‌লোভা‌বে বোঝা‌নোর, কাল সময় ক‌রে আবার বলব।”
তার অসামান্য কিছু কথা  আজো হৃদ‌য়ে গেঁ‌থে আ‌ছে। তি‌নি ব‌লে‌ছি‌লেন, “আমার বাবা গ্রা‌মের সামান্য কৃষক ছি‌লেন, ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়া‌শোনা করা মানুষ। আর আ‌মি পিএইচ‌ডি ক‌রে‌ছি। আমার বাবার জ্ঞান-বু‌দ্ধির চার  আনাও অর্জন করতে পা‌রি নি।”
তি‌নি আ‌রো বল‌তেন, “নটর ডেম তোমা‌দের হৃদয়বৃ‌ত্তির বিকাশ ঘটা‌তে পার‌বে না এমন শিক্ষা দে‌বে না। আমরা হৃদয়ের বি‌নিম‌য়ে ম‌স্তি‌স্কের উন্নয়ন চাই না।”
তার আ‌রেক‌টি কথা ম‌নে প‌ড়ে প্রায়ই। তি‌নি কোন এক‌দিন ব‌লে‌ছি‌লেন, “আমি ম‌নে ক‌রি ও বিশ্বাস ক‌রি নটর ডে‌মের একজন ছাত্র কোন পা‌নির ট্যাপ থে‌কে অকারণ পা‌নি পড়‌তে দেখ‌লে সেটা বন্ধ ক‌রে দে‌বে, আর কেউ করুক বা না করুক। কারণ এ শিক্ষা আমরা তা‌কে দি‌য়ে‌ছি।” সহজ কথায় কী অসাধারণ জীবন দর্শন ও মূল্য‌বো‌ধের শিক্ষা!
‌খ্রিস্টান ছাত্র/ছাত্রী‌দের পড়া‌শোনায় অম‌নো‌যো‌গিতা ও তুলনামূলক খারাপ রেজা‌ল্টের কারণে তি‌নি ম‌নে ম‌নে ক্ষুব্ধ ছি‌লেন। তি‌নি বল‌তেন, “আমরা এত ভা‌লো ভা‌লো প্র‌তিষ্ঠান করেছি, যেখা‌নে অন্য ধ‌র্মের মানুষ এসে ম‌ণিমুক্তা নিয়ে যায়, আর খ্রিস্টানরা কিছুই নি‌তে পা‌রে না।” তি‌নি আ‌রো বল‌তেন, “‌খ্রিস্টানরা মুর‌গির ম‌তো খুদ কুঁড়া খে‌য়ে খু‌শি, তারা কোন দিন ঈগল পা‌খির ম‌তো উড়ে ‌বেড়া‌নোর স্বপ্ন দে‌খে না।”
বিনম্র জ্ঞানী মানুষ‌টি তার জীবনাদর্শ দি‌য়ে শিক্ষা দি‌য়ে গে‌ছেন আজীবন। ঐ‌হিত্যবাহী নটর ডেম ক‌লেজ‌কে সব দিক দি‌য়ে দে‌শের শ্রেষ্ঠ বিদ্যা‌পি‌ঠে পরিণত ক‌রে গে‌ছেন তার আম‌লেই। দে‌শের প্রথম ও একমাত্র ক্যাথ‌লিক চার্চ প‌রিচা‌লিত বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা ও প‌থিকৃৎ তি‌নি। তাঁর ছা‌ত্রেরা  আজ দেশ বি‌দে‌শে নানাভা‌বে অসামান্য কাজ ক‌রে নটর ডে‌মে তার দেয়া শিক্ষা‌কে বিশ্বব্যাপী ছ‌ড়ি‌য়ে দিচ্ছে। তি‌নি যেমন বল‌তেন, “‌তোমরা যেখা‌নে যাও বা যা কর ম‌নে রে‌খো তোমরা নটর ডে‌মের সন্তান। তোমরাই এ‌কেক‌টি নটর ডেম হ‌য়ে ও‌ঠো।”
বেশ কিছুকাল যাবৎ তি‌নি নানা‌বিধ শারী‌রিক জ‌টিলতায় ভুগ‌ছি‌লেন, দে‌শে বি‌দে‌শে উন্নত চি‌কিৎসা ক‌রেও শেষ রক্ষা আর হ‌লো না। অ‌ক্টোবর ১৩, ২০১৭ তা‌রি‌খে পৃ‌থিবীর সব মায়া কা‌টি‌য়ে তি‌নি অনন্তধা‌মে যাত্রা ক‌রে‌ছেন। আজ দে‌শের শিক্ষা ব্যবস্থার শিরায় শিরায় অ‌নিয়‌ম ও দুর্নী‌তি বাসা বেঁ‌ধে‌ছে। এ‌হেন দুর্দশার কা‌লে তার ম‌তো একজন  মহান শিক্ষাব্রতী ও শিক্ষাগুরুর প্রস্থা‌নে দেশ ও জা‌তির যে চরম ক্ষ‌তি হ‌য়ে গেল তা কোন‌দিন পূরণ হবার নয়।
পৃ‌থিবীর নিয়‌মে জন্ম নি‌লে মর‌তে হ‌বে এর ব্যত্যয় হ‌বে না। ৭৫ বছ‌রের জীব‌নে সমাজ, দেশ ও বিশ্ব‌কে সবটাই তি‌নি দি‌য়ে গে‌ছেন। তি‌নি চ‌লে গে‌লেও তার কী‌র্তি থাক‌বে অম‌লিন, অ‌বিনাশী।
শু‌নে‌ছি নক্ষ‌ত্রের না‌কি কোন‌দিন মৃত্যু হয় না। জীবন সীমা শেষ হ‌লে নক্ষত্র বি‌স্ফো‌রিত হ‌য়ে নতুন নক্ষ‌ত্রের জন্ম হয়, নতুনভা‌বে তা গ্রহ উপগ্রহ‌কে ‌আলো‌কিত ক‌রে। বাংলা‌দে‌শের ভাগ্যাকাশ হ‌তে ফা: বেঞ্জা‌মিন নামক নক্ষ‌ত্রের যব‌নিকাপাত ঘট‌লো ব‌টে, কিন্তু তা কোন পতন নয়। কারণ নক্ষত্র কখ‌নো ম‌রে না, তার পুনর্জন্ম হয়।
য‌দি পরকাল বা জন্মান্তর ব‌লে কিছু থে‌কে থা‌কে, আবার যেন সে মহা নক্ষ‌ত্রের দর্শন পাই। ততকাল তি‌নি বেঁ‌চে থাকুন হৃদয়প‌দ্মে, এপা‌রের ম‌তো ভা‌লো থাকুন ওপা‌রেও।।
রক রোনাল্ড রোজারিওসাংবাদিক  লেখক

No comments:

Post a Comment

দক্ষিণ এশিয়ায় ভোটের রাজনীতি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়

Bangladeshi Christians who account for less than half percent of some 165 million inhabitants in the country pray during an Easter Mass in D...