২০১৮ রাশিয়া ফুটবল বিশ্বকাপ যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমীর মত বাংলাদেশের জনগণও ক্রমশ ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। হাটে, মাঠে, ঘাটে এবং অধুনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রিয় দলের সমর্থনে প্রচার, তর্ক এবং বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়ে গেছে।
আমি কখনো ভাল ক্রীড়াবিদ বা ফুটবলার ছিলাম না। তবে সর্বদা নিজেকে ফুটবল অন্তঃপ্রাণ ও ক্রীড়ামোদী হিসেবে মনে করি। আমার ফুটবল অনুরাগ শুরু ১৯৯৪ ইতালি বিশ্বকাপ থেকে। ব্রাজিলীয় তারকা রোমারিও যে বিশ্বকাপে দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন এবং ২৪ বছরের প্রতীক্ষা শেষে ব্রাজিলকে ৪র্থ বারের মত বিশ্বসেরা ফুটবল টিম হিসেবে শিরোপাধারী করতে সক্ষম হন।
আমি তখন মাত্র ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র। সেই সময় থেকে ব্রাজিল ফুটবল দলের একনিষ্ঠ ভক্ত বনে গেলাম, যদিও ফুটবল ইতিহাসের এ শ্রেষ্ঠ দলটির সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না। যখন বড় হলাম ধীরে ধীরে ব্রাজিল ও বিশ্ব ফুটবলে দেশটির একচ্ছত্র আধিপত্য সম্পর্কে জানলাম। যতই জানলাম ততই মুগ্ধ হলাম এবং কালক্রমে দলটির প্রতি ভালবাসা ও সমর্থন তুঙ্গে উঠতে থাকল। জীবনে বহু রকমের অনিশ্চয়তার মাঝেও তাই আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব যতদিন বেঁচে আছি ততদিন ব্রাজিল ফুটবল দলকে ভালবাসা ও সমর্থন জানিয়ে যাব। আমি অন্ধ ভক্ত নই, সব জেনে ও বুঝেই আজীবনের জন্য ব্রাজিল ভক্ত হয়েছি।
ফুটবলের মহাতারকা পেলে ১৯৭০ মেক্সিকো বিশ্বকাপ জয়ের পর ফুটবলকে "জোগো বনিতো" বা "নান্দনিক ক্রীড়া" (The Beautiful Game) হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ব্রাজিল ফুটবল দল ও জনগণ সর্বদাই সে নান্দনিক ক্রীড়ার পূজা করে এসেছে। মাঝখানে কিছু সময় রক্ষণাত্মক ফুটবল ও ছন্দপতন ঘটলেও ব্রাজিল পুনরায় চিরায়ত নান্দনিক শৈলী নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। এবারের বিশ্বকাপে তাই ব্রাজিল অন্যতম হট ফেভারিট, একথা ফুটবল বিশ্লেষকরাই জোরে শোরে বলছেন। ছন্দময় ব্রাজিল যে কোন ফুটবল টিমের জন্য ভয়ংকর সুন্দর হিসেবে আবির্ভূত হতে সক্ষম তা যেকোনো ফুটবলপ্রেমীই স্বীকার করতে বাধ্য। শুধু লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে থেকে সবার আগে রাশিয়া ২০১৮ বিশ্বকাপের টিকিট কেটেছে বলেই নয়, বরং এ বিশ্বকাপে সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ দল নিয়ে গেছে ব্রাজিল। ব্রাজিল দলের রিজার্ভ বেঞ্চের খেলোয়াড়দের পেলেও বিশ্বের যেকোন দেশ লুফে নেবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে বিশাল আমাজন মহাবন ও খরস্রোতা আমাজন নদীর অববাহিকায় অবস্থিত দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের সর্ববৃহৎ দেশ ব্রাজিল। আয়তনে ব্রাজিল আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বড়। কিন্তু দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ২০ কোটির কিছু বেশি। তার প্রধান কারণ দেশটির বিরাট একটি অংশ মানুষের বসবাসের জন্য অনুপযোগী, মূলত ভৌগলিক কারণে। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে দেশটি পর্তুগিজ অভিযাত্রী ও নাবিক পেদ্রো আলভারেজ ক্যাবারাল কর্তৃক আবিস্কারের পূর্বে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অভয়ারন্য ছিল। পর্তুগিজদেও আগমনের পর থেকে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত পর্তুগিজ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ ছিল। ব্রাজিলের সুবিখ্যাত রিও-ডি-জেনেইরো শহর বেশ কিছুকাল গোটা পর্তুগিজ সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ব্রাজিল (পর্তুগিজ "ব্রাসিল") নামটাও পর্তুগিজদের দেয়া। “ব্রাসিল” মানে হলো “জ্বলন্ত আগুনের মতো লাল”। ব্রাজিলে পৌঁছার পর পর্তুগিজরা এর উপকূলবর্তী অঞ্চলে “ব্রাসিল উড” নামের এক ধরণের বিশেষ প্রজাতির গাছের সন্ধান পায়, যে গাছের কাঠ থেকে লাল রঙ প্রস্তুত করা যায়। এ গাছ বেশ দামি বিবেচিত হয় কারণ সে সময় ইউরোপে ক্রমবর্ধমান পোশাক শিল্পে এ রঙ অত্যন্ত মূল্যবান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। “ব্রাসিল” শব্দটি লাতিন “ব্রাসা” থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়, যার মানে হলো “জ্বলন্ত আগুন”। পর্তুগিজ ব্রাজিলের রাষ্ট্রভাষা। দেশটির প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ খ্রিস্টান, অধিকাংশ কাথলিক চার্চের অনুসারী।
কিন্তু ব্রাজিলের মানুষের কাছে ফুটবল হলো প্রথম ধর্ম ও প্রথম ভালোবাসা। কথিত আছে, ব্রাজিলবাসী তার ধর্ম ত্যাগ করতে পাওে, প্রেমিক তার প্রেমিকাকে ছেড়ে চলে যেতে পাওে শুধুমাত্র ফুটবলের কারণে। যে ব্যবসায়ী তার ব্যবসায় বিরাট ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে, সে-ও নাকি তার সামান্যতম পুঁজি ফুটবলের স্বার্থে বিসর্জন দিতে পারে। ব্রাজিলের জনগণ ফুটবলকে তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে নিয়েছে। ফুটবলের প্রতি এ প্রগাঢ় ভালোবাসা ও আবেগ ব্রাজিল ফুটবল দলের প্রধান শক্তি ও সে কারণে ব্রাজিল শুধু বিশ্বকাপের ইতিহাসেই নয়, বরং ফুটবলের ইতিহাসেই সবচেয়ে সফল দল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। ব্রাজিলের সাফল্যের পরিসংখ্যানে ও তাদের ট্রফি কেসে নজর বুলালে ব্যাপারটি আরো বেশি বোধগম্য হবে।
ফিফা বিশ্বকাপ (১৯৩০ হতে সব কটিতে অংশগ্রহণ)
শিরোপাঃ ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৯৪, ২০০২
রানার্স-আপঃ ১৯৫০, ১৯৯৮
কোপা আমেরিকা
শিরোপাঃ ১৯১৯, ১৯২২, ১৯৪৯, ১৯৮৯, ১৯৯৭, ১৯৯৯, ২০০৪, ২০০৭
রানার্স-আপঃ ১৯২১, ১৯২৫, ১৯৩৬, ১৯৪৫, ১৯৪৬, ১৯৫৩, ১৯৫৭, ১৯৫৯, ১৯৮৩, ১৯৯১, ১৯৯৫
কনকাফাফ গোল্ড কাপ
শিরোপাঃ ১৯৯৬ ও ২০০৩
ফিফা অনুর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপ
শিরোপাঃ ১৯৮৩, ১৯৮৫, ১৯৯৩, ২০০৩
রানার্স-আপঃ ১৯৯১, ১৯৯৫
ফিফা ফুটসাল বিশ্বকাপ
শিরোপাঃ ১৯৮৯, ১৯৯২, ১৯৯৬, ২০০৮
রানার্স-আপঃ ২০০০
ফিফা কনফেডারেশনস কাপ
শিরোপাঃ ১৯৯৭, ২০০৫, ২০০৯
রানার্স-আপঃ ১৯৯৯
ফিফা অনুর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপ
শিরোপাঃ ১৯৯৭, ১৯৯৯, ২০০৩
রানার্স-আপঃ ১৯৯৫, ২০০৫
ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ
শিরোপাঃ ২০০০, ২০০৫, ২০০৬
রানার্স-আপঃ ২০০০
ফিফা বিচ সকার বিশ্বকাপ
শিরোপাঃ ২০০৬, ২০০৭, ২০০৮
অলিম্পিক ফুটবল
শিরোপাঃ ২০১৬
রানার্স-আপঃ ১৯৮৪, ১৯৮৮
১৯৩০ থেকে ২০১৮ সব কয়টি বিশ্বকাপে একমাত্র দল হিসেবে ব্রাজিল অংশ নিতে সক্ষম হয়েছে, য়ে রেকর্ড কোনদিন ভাঙ্গার নয়। শুধু সর্বাধিক ৫টি বিশ্বকাপ ট্রফি জয় নয়, ব্রাজিল এ পর্যন্ত সর্বাধিক ম্যাচে জয় পেয়েছে (৭০)। কালোমানিক পেলে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ৩ টি বিশ্বকাপ জয় করেছেন, যে রেকর্ড আর কোন খেলোয়াড় স্পর্শ করতে পারবে বলে মনে হয় না। ব্রাজিল একমাত্র দল যারা চারটি ভিন্ন মহাদেশে বিশ্বকাপ জয় করেছে এবং লাতিন আমেরিকার একমাত্র দল হিসেবে ইউরোপে (১৯৫৮, সুইডেন) বিশ্বকাপ জিতেছে।
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে বিশ্বনন্দিত তারকা পেলে, জিকো, রোমারিও, বেবেতো, রোনালদো, রিভালদো, রোনালদিনহো, রবার্তো কার্লোস, কাকা, কাফু ও আদ্রিয়ানোদের যোগ্য উত্তরসুরীরা যে “হেক্সা” (ষষ্ঠ বিশ্বকাপ) জয়ের জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে গেছেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাছাইপর্বে সর্বাধিক পয়েন্ট ও সর্বাধিক গোল (৪১) প্রমাণ করে তাদের সামর্থ্য। আর কারো যদি তাদের সক্ষমতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থেকে থাকে তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের জয়গুলোর দিকে নজর দিলে তা উবে যাবে--বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে ১-০, বিশ্বকাপ প্রস্তুতি ম্যাচে ক্রোয়েশিয়াকে ২-০ ও অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়। উল্লেখ্য, অস্ট্রিয়া এ বিশ্বকাপে সুযোগ না পেলেও এক প্রস্তুতি ম্যাচে জার্মানিকে ২-১ গোলে হারিয়েছে।
বিশ্বকাপ দুয়ারে কড়া নাড়ছে, আর তাই বিশ্বজুড়ে ও বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি ব্রাজিল ভক্তের ন্যায় আমি চাই ক্যানারী হলুদ জার্সিধারীরা নান্দনিক ফুটবল খেলে শুধু মনই ভরাবে না, বরং ৬ষ্ঠ বারের মতো বিশ্ব জয়ের বন্দরে নোঙ্গর ফেলুক। ১৫ জুলাই মস্কোর ফাইনালে ব্রাজিল শিরোপা জয় করুক, এ প্রত্যাশাই করি। ব্রাজিল যদি ব্রাজিলের মতো খেলে তাদের সেরাটা দিয়ে, তবে তাদেও বিজয় মুকুট জয়ের পথে কেউ বাধা হতে পারবে না। ব্রাজিল ফর হেক্সা! ভিভা ব্রাজিল!
শিরোপাঃ ২০১৬
রানার্স-আপঃ ১৯৮৪, ১৯৮৮
১৯৩০ থেকে ২০১৮ সব কয়টি বিশ্বকাপে একমাত্র দল হিসেবে ব্রাজিল অংশ নিতে সক্ষম হয়েছে, য়ে রেকর্ড কোনদিন ভাঙ্গার নয়। শুধু সর্বাধিক ৫টি বিশ্বকাপ ট্রফি জয় নয়, ব্রাজিল এ পর্যন্ত সর্বাধিক ম্যাচে জয় পেয়েছে (৭০)। কালোমানিক পেলে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ৩ টি বিশ্বকাপ জয় করেছেন, যে রেকর্ড আর কোন খেলোয়াড় স্পর্শ করতে পারবে বলে মনে হয় না। ব্রাজিল একমাত্র দল যারা চারটি ভিন্ন মহাদেশে বিশ্বকাপ জয় করেছে এবং লাতিন আমেরিকার একমাত্র দল হিসেবে ইউরোপে (১৯৫৮, সুইডেন) বিশ্বকাপ জিতেছে।
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে বিশ্বনন্দিত তারকা পেলে, জিকো, রোমারিও, বেবেতো, রোনালদো, রিভালদো, রোনালদিনহো, রবার্তো কার্লোস, কাকা, কাফু ও আদ্রিয়ানোদের যোগ্য উত্তরসুরীরা যে “হেক্সা” (ষষ্ঠ বিশ্বকাপ) জয়ের জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে গেছেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাছাইপর্বে সর্বাধিক পয়েন্ট ও সর্বাধিক গোল (৪১) প্রমাণ করে তাদের সামর্থ্য। আর কারো যদি তাদের সক্ষমতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থেকে থাকে তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের জয়গুলোর দিকে নজর দিলে তা উবে যাবে--বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে ১-০, বিশ্বকাপ প্রস্তুতি ম্যাচে ক্রোয়েশিয়াকে ২-০ ও অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়। উল্লেখ্য, অস্ট্রিয়া এ বিশ্বকাপে সুযোগ না পেলেও এক প্রস্তুতি ম্যাচে জার্মানিকে ২-১ গোলে হারিয়েছে।
বিশ্বকাপ দুয়ারে কড়া নাড়ছে, আর তাই বিশ্বজুড়ে ও বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি ব্রাজিল ভক্তের ন্যায় আমি চাই ক্যানারী হলুদ জার্সিধারীরা নান্দনিক ফুটবল খেলে শুধু মনই ভরাবে না, বরং ৬ষ্ঠ বারের মতো বিশ্ব জয়ের বন্দরে নোঙ্গর ফেলুক। ১৫ জুলাই মস্কোর ফাইনালে ব্রাজিল শিরোপা জয় করুক, এ প্রত্যাশাই করি। ব্রাজিল যদি ব্রাজিলের মতো খেলে তাদের সেরাটা দিয়ে, তবে তাদেও বিজয় মুকুট জয়ের পথে কেউ বাধা হতে পারবে না। ব্রাজিল ফর হেক্সা! ভিভা ব্রাজিল!