সদ্য প্রয়াত আর্চবিশপ মজেস মন্টু কস্তা, সিএসসি মহোদয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে, জাতীয় ক্যাথলিক পত্রিকা সাপ্তাহিক প্রতিবেশীর সৌজন্যে। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র, বয়স সবে দশ পেড়িয়ে এগারো। প্রতিবেশী পড়ে জানলাম ৪৬ বছর বয়সী ফাদার মজেসকে পোপ ২য় জন পল দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের বিশপ নিযুক্ত করেছেন। সে সময় তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ ক্যাথলিক বিশপ। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র ক্রুশ (Holy Cross) সম্প্রদায়ের যাজক হিসেবে অভিষেকের ১৫ বছরের মাথায় তিনি এ মান্ডলিক গুরুদায়িত্ব পান। তাঁর সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা সম্ভব ছিল না, কারণ একে তো আমার বয়স ছিল কম এবং তখন বর্তমান জমানার মতো গণমাধ্যম (মূলধারা ও ধর্মীয়) ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না, তথ্য পাওয়া ছিল কঠিন ব্যাপার।
পরবর্তীকালে আমার সেমিনারী জীবনে (১৯৯৯-২০০৭) যাজক ও বিশপ মজেস সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে এবং বিভিন্ন প্রোগ্রামে উনার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। এক অজ্ঞাত কারণে, অধিকাংশ সেমিনারীয়ানের মধ্যে বিশপ ও আর্চবিশপদের সম্পর্কে বিশেষ ভীতি কাজ করে, তারা তাদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। আমিও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলাম না। সুতরাং সেমিনারী জীবনে বিশপ মজেসসহ অন্যান্য ধর্মগুরুদের সাথে অনেকবার সাক্ষাৎ হলেও ব্যক্তিগত আলাপের সুযোগ ঘটেনি। উনার সাথে সত্যিকার সাক্ষাত ও পরিচয় হয় ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহের বিড়ইডাকুনী ধর্মপল্লীতে যেখানে ২৪তম জাতীয় যুব দিবসের আসর বসেছিল, যার মূলভাব ছিল: "আমরা তো আশা-ভরসা রেখেছি স্বয়ং জীবনময় ঈশ্বরেরই উপর" (১ তিমথি ৪:১০)।
বিশপ মজেস তখন বিশপীয় (CBCB) যুব কমিশনের চেয়ারম্যান। আমি তখন সদ্য সেমিনারী ছেড়ে হংকংভিত্তিক ক্যাথলিক সংবাদ মাধ্যম UCAN-এ চাকুরি শুরু করেছি এবং বিশপীয় যুব কমিশনের সেক্রেটারি ফাদার প্যাট্রিক শিমন গমেজের উৎসাহে কমিশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য পদে যোগদান করেছি। যুব দিবসে অংশ নিয়েছিলাম রিপোর্টিং ও ডকুমেন্টেশন উপ-কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে এবং UCAN এর জন্য রিপোর্ট করার উদ্দেশ্যে। চারদিনের প্রোগ্রামে প্রতি রাতে মূল্যায়ন মিটিং হতো কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যবৃন্দ ও সকল কমিটির আহ্বায়কদের সমন্বয়ে। বিশপ মজেস সকল মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতেন এবং যেকোন প্রকার সমস্যার সমাধান করে দিতেন। অনেক সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরিস্থিতি কিংবা সদস্যরা উত্তপ্ত হলেও তিনি বরাবর সহনশীল ছিলেন, এবং যা সবচেয়ে ভালো সেটার বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে সহায়তা করতেন। তখন থেকে তাঁর প্রতি আমার বিশেষ শ্রদ্ধা জন্মে। যুব দিবসে তিনি খুব বেশি বক্তব্য দেন নি যদিও পুরো সময় তিনি গোটা প্রোগ্রামে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর বলা অনেক সুন্দর কথার মাঝে যেটা বেশি মনে পড়ে তা হলো, "যুব দিবস একটি উৎসব এবং একটি তীর্থযাত্রা, যেখানে আমরা যীশুর সঙ্গে পথ চলতে ও বেড়ে উঠতে শিখি প্রার্থনায় ও আনন্দময়তায়।"
বিড়ইডাকুনীর পরে রাজশাহীর পালকীয় সেবাকেন্দ্র (২০১০), ঢাকার কেওয়াচালা ধর্মপল্লী (২০১১) ও চট্টগ্রামের দিয়াং আশ্রমে আঞ্চলিক ( ২০১১) ও জাতীয় (২০১৩) যুব দিবসে বিশপ মজেসের সাহচর্য্য লাভের সুযোগ হয়েছে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের বিশপ পদে আসীন হওয়ার এবং ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে আর্চবিশপ পদে অধিষ্ঠান অনুষ্ঠান কাভার করেছি। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নানা সামাজিক ও ধর্মীয় ইস্যুভিত্তিক রিপোর্ট করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। ব্যক্তিগত সম্মান ও শ্রদ্ধার বাইরে ধর্মগুরু মজেসের সাথে আমার পরিচয় ও সম্পর্ক মূলত পেশাদারিত্বের এবং একদার যুবকর্মী হিসেবে। তাঁর সাথে কোন ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক লেনদেন করার প্রয়োজন বা সুযোগ হয় নি কোনদিন। তবুও করোনা ভাইরাসে তাঁর রোগভোগ, রোগমুক্তি এবং সর্বশেষ বিগত ১৩ জুলাই মস্তিস্কে রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে অকস্মাৎ মৃত্যু আমাকে যারপরনাই ব্যথিত করেছে। তাঁর মতো একজন সুযোগ্য ধর্মগুরুর সহসা প্রস্থান বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর জীবন ও কর্মের নির্মোহ বিশ্লেষণ করে এবং তাঁর সাথে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বরাতে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় তিনি ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম (অনন্য, তুলনাহীন)। মানুষমাত্রেই সকলের সবলতা ও দুর্বলতা থাকে, তিনিও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কিন্তু তাঁর সবলতাগুলো অসামান্য ও অভাবনীয়, যা তাঁকে বাংলাদেশ ক্যাথলিক মন্ডলীতে ও ভক্তদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সে কারণে দিনাজপুর ও চট্টগ্রামের পর ঢাকার আগামী আর্চবিশপ পদে তিনি একজন জোরালো প্রার্থী ছিলেন, বিশ্বস্ত সূত্রে তা জানা গেছে। কিন্তু ৭০ বছর বয়সে তাঁর মহাপ্রয়াণ মন্ডলীতে অধিকতর সেবাদানের পথ রুদ্ধ করেছে। তাঁর মহাজীবনের মূল্যায়ন করা বেশ দুস্কর, তবুও আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় তাঁর কীর্তি ও প্রয়াসের প্রতি আলোকপাত করার প্রয়াস।