Rohingya refugees in Cox's Bazar in September, 2017 (Photo: Stephan Uttom) |
মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জাতিগত নি:স্বকরণ (Ethnic Cleansing) প্রক্রিয়ার সঙ্গে রুয়ান্ডার তুতসি জনগোষ্ঠীর গনহত্যার ব্যাপক ধরণের সাদৃশ্য রয়েছে। তুতসি গণহত্যা (Genocide) আধুনিক বিশ্বে সংঘটিত সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে এ গণহত্যা সংঘটিত হয়। রুয়ান্ডার সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতু সম্প্রদায়ের জঙ্গীগোষ্ঠী ও হুতু সমর্থিত সরকারের সেনাবাহিনীর হাতে এ সময়কালে প্রায় ১০ লক্ষ সংখ্যালঘু তুতসি হত্যাকান্ডের শিকার হয়।
এ গণহত্যা ছিল মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় সুদীর্ঘকাল ধরে চলা জাতিগত বিদ্বেষ ও সহিংসতার চরম ও নিষ্ঠুরতম পর্যায়।
গণহত্যার সূত্রপাত হয়েছিল রুয়ান্ডার তৎকালীন হুতু রাষ্ট্রপতি জুভেনাল হাইবিয়ারিমানার হত্যাকান্ডের জের ধরে। এপ্রিলের ১৪ তারিখ তিনি রাজধানী কিগালিতে তার বিমানে এক রকেট হামলায় নিহত হন।
হুতুরা এ হত্যাকান্ডের জন্য তুতসি বিদ্রোহী গোষ্ঠী রুয়ান্ডা প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট (Rwanda Patriotic Front)- কে দায়ী করে। কিন্তু আরপিএফ'র তৎকালীন নেতা ও রুয়ান্ডার বর্তমান রাষ্ট্রপতি পল কাগামে পাল্টা অভিযোগ করেন যে হুতু জঙ্গীরা তুতসি গণহত্যার অজুহাত তৈরি করতে এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বহুলাংশে নীরবতা অবলম্বন করে যে সময় এ গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছিল। বেশ কিছুদিন পর জাতিসংঘ যখন রুয়ান্ডায় শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করে ও তৎকালীন রক্তপিপাসু সরকারের পতন ঘটে, ততদিনে লক্ষ লক্ষ নিরীহ তুতসি ভয়ংকর গণহত্যার শিকার হয়েছে।
হুতুদের চেয়ে লম্বাকৃতি ও তুলনামূলক গায়ের রঙ কম কালো, তাই তুতসিদের আদি বাসস্থান ইথিওপিয়া বলে ধারণা করা হয়। আর তাই গণহত্যার পর হুতুরা তুতসিদের মৃতদেহগুলো নদীর জলে নিক্ষেপ করে এবং বলে তারা তাদের পুনরায় ইথিওপিয়াতে ফেরত পাঠাচ্ছে, যেখান থেকে তারা একদিন এসেছিল।
১৯১৬-৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রুয়ান্ডা বেলজিয়ামের উপনিবেশ ছিল। এ সময়ে শাসকেরা তুতসিদের শারীরিক সৌন্দর্য্যকে প্রাধান্য দিয়ে হুতুদের চেয়ে তাদের অধিক হারে চাকুরি, শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। তুতসিরা সানন্দে সেসব গ্রহণ করে এবং হুতুদের মধ্যে তা ব্যাপক ক্ষোভ ও বিদ্বেষের জন্ম দেয়। বেলজিয়ান শাসনামল ও তার পরবর্তীকালে তাই রুয়ান্ডায় জাতিগত বিদ্বেষ ও সহিংসতা ক্রমশ চরম মাত্রা ধারণ করে, যার নির্মম প্রকাশ ছিল তুতসি গণহত্যা।
রোহিঙ্গা নিধনের সাথে সাদৃশ্য
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তুলনামূলক কৃষ্ণকায় রোহিঙ্গা মুসলিম, যাদের নিজস্ব ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে, তারাও অনেকটা একই ধরণের নির্যাতনের শিকার।
রোহিঙ্গা একটি মিশ্র জাতি যাদের রক্তে আছে আরবীয় বণিক, বাঙালি অভিবাসী ও স্থানীয় আরাকানী (রাখাইন) জনগোষ্ঠীর মিশ্রণ। শত শত বছর পূর্বে থেকেই তৎকালীন আরাকান রাজ্যের ইতিহাসে তাদের অস্তিত্ব বর্ণিত রয়েছে। কিন্তু, পরিতাপের বিষয় বার্মা (মায়ানমার) রাষ্ট্র তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে এসেছে যুগ যুগ ধরে। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের নাগরিগত্ব আইন দ্বারা মায়ানমারের সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার রোহিঙ্গাদেরকে দেশটির ১৩৪ টি স্বীকৃত জাতিসত্ত্বার মধ্যে অন্তভুক্ত করে নি। এর ফলে রাষ্ট্রীয়ভাবে রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন করা হয়, যা আজও বলবৎ রয়েছে। সে থেকে আজ অবধি রোহিঙ্গাদেরকে সাম্প্রতিককালে মায়ানমারে অবৈধ বাঙালি অনুপ্রবেশকারী আখ্যায়িত করা হচ্ছে। পাশাপাশি তাদেরকে হত্যাসহ সর্বপ্রকার শারীরিক, মানসিক, ধর্মীয় ও জাতিগত নির্যাতন করে দেশত্যাগে বাধ্য করা চলছে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এ রক্তক্ষয়ী নির্যাতন ও নিষ্পেষণের মূল হোতা মায়ানমারের সেনাবাহিনী ও সেনানিয়ন্ত্রিত সরকার। কিন্তু তাদের দোসররাও কোন অংশে কম দায়ী নয়।
বৌদ্ধ রাখাইন জনগোষ্ঠী, যারা যুগ যুগ ধরে বর্মী সেনাবাহিনী ও বর্মী শাসকগোষ্ঠীকে দখলদার শত্রু হিসেবে গণ্য করে এসেছে, বহুকাল স্বাধীনতা সংগ্রাম করে এসেছে, তারাই আজ কালের বিবর্তনে সেনাবাহিনী সাথে হাত মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের বলির পাঁঠা করে চলেছে।
এছাড়াও রয়েছে, চরম মুসলিমবিদ্বেষী ও তথাকথিত জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা, যারা সাধারণ জনগণের মননে জাতিগত ও ধর্মীয় বিদ্বেষের বীজ বপন করে চলেছে প্রতিনিয়ত। তারা এ মিথ্যা প্রোপাগান্ডা প্রচার করে যে মুসলিমরা মায়ানমারকে একদিন দখল করে নেবে, আর তাই মায়ানমারের জাতিগত, ধর্মীয় ও সংস্কৃতিগত অস্তিত্ব ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য মুসলমান তথা রোহিঙ্গাদেরকে দেশছাড়া করার বিকল্প নেই। এখানে উল্লেখ্য যে প্রায় পাঁচ কোটি জনসংখ্যার মায়ানমারে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ৮০ শতাংশ আর মুসলিম ১ শতাংশের মতো। সুতরাং, মুসলিমদের দ্বারা মায়ানমার দখলের মতবাদ অলীক কল্পনা ব্যতীত কিছুই নয়।
ইসলাম ভীতি বা ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানোর যৌক্তিক কোন ভিত্তি না থাকলেও এর পেছনে সেনাবাহিনী, বর্মী আধিপত্যবাদী ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক, সরকারনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম, কট্টরপন্থী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও জনগণের চরম জাতীয়তাবাদী একটি বিরাট অংশের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এর পেছনে যতটা না ধর্মীয় বা জাতিগত বিষয় জড়িত তার চেয়ে অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এজেন্ডা জড়িত।
রোহিঙ্গা নির্যাতনের সর্বসাম্প্রতিক নজির ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগস্ট ও তৎপরবর্তী মাসগুলোতে দেখা গেছে। রোহিঙ্গা জঙ্গীগোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা সালভ্যাশন আর্মি (আরসা) কর্তৃক রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনী ও সেনা ছাউনিতে হামলার প্রতিশোধ নিতে মায়ানমার সেনা বাহিনী ও রাখাইনের জঙ্গী বৌদ্ধরা নিরীহ রোহিঙ্গাদের উপর ব্যাপক তান্ডব চালায়। শত শত নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যাকান্ডের শিকার হন, অগণিত নারীদের ধর্ষণ ও নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয় এবং শত শত রোহিঙ্গা গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এ উন্মাদ হত্যালীলা থেকে বাঁচতে আজ অবধি প্রায় সাত (৭) লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আরসার হামলার মতো একটি সামান্য অজুহাতে মায়ানমার সেনাবিাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর চরম বর্বরোচিত নিপীড়ন চালিয়েছে, যা জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা "জাতিগত নি:স্বকরণ" (Ethnic Cleansing) হিসেবে আখ্যায়িত করে কঠোর নিন্দা জানিয়েছে।
অনেকে মনে করেন, মায়ানমার সেনাবাহিনী আদতে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন রাখাইন উপদেষ্টা কমিশনের বিশেষ প্রতিবেদন থেকে বিশ্বের নজর অন্যদিকে ফেরাতে এ হামলার সাজানো নাটক মঞ্চস্থ করেছে। কফি আনান কমিশনের বিভিন্ন সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের নাগরিকত্ব আইনের পুনর্মূল্যায়ন ও সংশোধন করা, যে আইনের জেরে রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে "রাষ্ট্রহীন" (stateless) করা হয়।
সুতরাং অনেকটাই রুয়ান্ডার হুতুরা তুতসিদের যেভাবে গণহত্যার মুখে ঠেলে দিয়েছিল, তেমনিভাবে মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের হত্যাকান্ডের মুখে ঠেলে দিয়ে ভিনদেশে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য করা হয়েছে।
২০১২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে রাখাইনে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় তার জের ধরে অভিবাসী একদল রোহিঙ্গা আরসা (পূর্বনাম হারাকাহ্ আল ইয়াকিন) জঙ্গীগোষ্ঠীর জন্ম দেয়। আরসা তাদের অস্তিত্বের প্রথম জানান দেয় ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ অক্টোবর সীমান্ত পুলিশ চৌকিতে হামলার মাধ্যমে। তাদের পরবর্তী আক্রমণের নজির হলো ২৫ আগস্ট।
রাখাইনে সাম্প্রতিক হামলা ও লাখো রোহিঙ্গার দেশত্যাগের পেছনে এগুলোই প্রধান কারণ।
ঔপনিবেশিক শাসনের কুফল
ব্রিটিশ শাসনামলে অন্য সকল উপনিবেশের মতোই বার্মাতেও কুখ্যাত “ভাগ করো ও শাসন করো” (Divide and Rule) নীতি বলবৎ ছিল। রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ শাসকদের মোক্ষম অস্ত্র, যা সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্ম ও জাতিভিত্তিক রক্তক্ষয়ী বিভাজন, হিংসা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অন্যতম প্রধান নিয়ামক।
ব্রিটিশ আমলে আরাকানে ব্যাপকহারে পূর্ব বঙ্গ থেকে বাঙালি মুসলিমদের নিয়ে যাওয়া হয় সরকারি মদদে। আপাত দৃষ্টিতে এর পেছনে আরাকানের কৃষি জমি থেকে শস্য উৎপাদন ও আর্থিক মুনাফা জড়িত ছিল বলে ধারণা করা হয়। আদতে তা ছিল আরেকটি রাজনৈতিক স্বার্থে ব্রিটিশ কারসাজি। আরাকানের রাখাইনরা সর্বদাই প্রচন্ড ব্রিটিশবিরোধী ছিল, আর তাই ব্রিটিশরা চেয়েছে তাদের সমানুপাতিক সংখ্যায় মুসলিমদেরকে বৌদ্ধ রাখাইনদের বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে।
ব্রিটিশরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে গেছে বটে, কিন্তু তা আরাকানে সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষ রোপণ করেছে চিরকালের মতো। রাখাইনরা মন থেকে কখনো বহিরাগত মুসলিমদের মেনে নিতে পারে নি। আর মুসলিমরাও তাদের পিঠ বাঁচাতে ব্রিটিশ প্রভুদের সর্বপ্রকার সহযোগিতা করে।
আরাকানে বৌদ্ধ-মুসলিম বিভাজন চরমভাবে পরিলক্ষিত হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে। ব্রিটিশরা মুসলিমদের আশ্বাস দেয় যে যুদ্ধ শেষে তারা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাবে। আর তাই স্বাধীনতার আশায় হাজারো মুসলিম ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করে ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অন্যদিকে, রাখাইন বৌদ্ধরা ব্রিটিশদেরকে বিতাড়নের লক্ষ্যে বার্মিজদের সাথে ব্রিটেনের শত্রু জাপানকে সমর্থন করে। মায়ানমারের নেত্রী সু চির বাবা জেনারেল অং সান ছিলেন স্বাধীন বার্মার স্বপ্নদ্রষ্টা ও পুরোধা, যিনি জাপানে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন এবং তৎকালীন জাপান সরকারের সরাসরি সহযোগিতা আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা বার্মা থেকে তাদের সাম্রাজ্য গুটিয়ে নেয়। কিন্তু তাদের আমলে মাথাচাড়া দিয়ে জাগা ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ ও সহিংসতা কালক্রমে বাড়তে থাকে।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের রেশ ধরে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এ সময় কিছু রোহিঙ্গা মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষপাতি ছিল। আবার কেউ কেউ রাখাইনদের মতো জঙ্গী সংগঠন গঠন করে বার্মিজ আধিপত্যবাদী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
বার্মিজ সেনাবাহিনী সে সময় থেকে রোহিঙ্গা জঙ্গী ও অন্যান্যদেরকে “অবৈধ বাঙালি অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে আখ্যায়িত করতে শুরু করে, যাদেরকে কোনভাবেই বার্মার নাগরিকত্ব দেয়া যাবে না মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এছাড়াও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইন বৌদ্ধদের জাতশত্রু (Common Enemy) হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বৃহৎ অংশটিকে নিজের দলে টেনে নেয়। আর তাই যে রাখাইনরা বহু বছর যাবৎ মুসলিমদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বাস করে এসেছে এবং বার্মিজ সেনাবাহিনী ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে একদা এক কাতারে লড়াই করেছে, নিয়তির নির্মম পরিহাসে তারাই সেনাবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে বলির পাঁঠা হিসেবে রোহিঙ্গা নির্যাতন ও নিধনে অস্ত্র হাতে তুলে নিল। সেনাবাহিনী সাথে একাট্টা হয়ে বৌদ্ধরা বলতে লাগল রোহিঙ্গারা এদেশের নাগরিক হবার যোগ্য নয়, তারা বাংলাদেশ হতে বার্মায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করেছে। ব্রিটিশ অনুসৃত “ভাগ কর ও শাসন কর” নীতির নতুন অধ্যায় শুরু হল এবং রোহিঙ্গাদেও জীবন ক্রমশই দুর্বিষহ হয়ে ওঠতে লাগল।
রোহিঙ্গাদেও দুর্দশাগ্রস্থ জীবন ইতিহাসের এক নির্মম পটপরিবর্তন। কেননা, বর্তমান মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য আসলে ২,০০০ বছরের স্বাধীন আরাকান রাজ্য হিসেবে ইতিহাসে বিধৃত হয়ে আছে। আরাকান রাজ্যে সুদীর্ঘকাল পূর্বে থেকেই (আনুমানিক ৮ম শতক) মুসলিমদের উপস্থিতি ও প্রভাবের কথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। আরাকানে বৌদ্ধ-মুসলিম সম্প্রীতি, প্রতিপত্তি ও শান্তি সংকটের মুখে পতিত হয় ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মিজ সেনাবাহিনীর আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের সময়কাল থেকে। পরবর্তীতে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে যখন ব্রিটিশরা বার্মাকে তাদের সাম্রাজ্যভুক্ত করে এবং আরাকানের শান্তি ও সমৃদ্ধি অধিকতর হুমকির মুখে পতিত হতে থাকে।
বর্তমান মায়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা মনে করে “রোহিঙ্গা” নামে কোন জনগোষ্ঠী তাদের দেশে কখনো ছিল না এবং সে কারণে রোহিঙ্গা শব্দটির প্রতি তাদের প্রবল আপত্তি ও ঘৃণা। এ ভ্রান্ত ধারণার অবতারণার পেছনে রয়েছে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ হতে মায়ানমারে ক্ষমতা দখলকারী সেনাবাহিনী ও বার্মিজ আধিপত্যবাদী রাজনীতিবিদ, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার বিরাট কুপ্রভাব।
আসলে রোহিঙ্গা শব্দটির মানে হল “রোহাংয়ের অধিবাসী” আর রোহাং হল আরাকানের মুসলিম নাম। সুতরাং বার্মিজরা মনে করে “রোহিঙ্গা” শব্দটি মেনে নেয়া মানে হচ্ছে মুসলিমরা যে আরাকানের আদি বাসিন্দা তা এক প্রকার স্বীকার করে নেয়া। আর তাই তারা চায় রোহিঙ্গা শব্দটিকে মুছে দিয়ে প্রকৃত অর্থে আরাকানে মুসলিম অস্তিস্ত, প্রভাব ও প্রতিপত্তি চিরতরে ইতিহাসের পাতা থেকে অবলোপন করতে।
বার্মিজ আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের পূর্বে তৎকালীন বার্মাতে অবিভক্ত ভারতের ন্যায় অনেকগুলো রাজ্য ছিল আরাকানের মতো। বার্মিজ রাজারা কালক্রমে সেসব দখল করে সাম্রাজ্যভুক্ত করে। ভারত-পাকিস্তানের মতো বার্মার আন্তর্জাতিক সীমানা ব্রিটিশরাই প্রথম চিহ্নিত করে। ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত সীমান্তে কোন প্রকার বিধি-নিষেধ ছিল না, কারণ সবাই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রজা। সে কারণে সীমান্তের এপার ও ওপারে অবাধে যাতায়াত করত লোকজন। তারই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবর্তী এলাকাতে রাখাইন বৌদ্ধদের বসতি দেখা যায়, যারা কালের পরিক্রমায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেছে।
দুর্ভাগ্যক্রমে, ভাগ্যদেবী রাখাইনদের ন্যায় রোহিঙ্গাদের উপর যে সুপ্রসন্ন ছিল না তা বলাই বাহুল্য।
অবহেলা ও প্রতিরোধ
সত্তরের দশক থেকে বার্মাতে রোহিঙ্গা নিপীড়ন ক্রমশ বাড়তে শুরু করে। অত্যাচার থেকে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার প্রবণতার সূচনা সে সময় থেকেই। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে পালিয়ে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা এদেশে চলে আসে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি শান্ত হলে পর তারা সবাই নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যায়।
১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে বার্মিজ সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদেও ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায় এবং এ সময় প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর (UNHCR)--এর তত্ত্বাবধানে প্রায় দুই লক্ষের মতো রোহিঙ্গা রাখাইনে ফিরে যায়। কিন্তু প্রায় ৩০,০০০ রোহিঙ্গা যারা মায়ানমার সরকারের শর্ত অনুযায়ী রাখাইনে তাদের বসবাস করার দালিলিক কোন প্রমান দিতে পারে নি, তারা বাংলাদেশে রয়ে যায়। তাদেরকে “শরনার্থী” হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউএনএইচসিআর এবং সরকারের তত্ত্বাবধানে কক্সবাজারের নয়াপাড়া ও কুতুপালং শরনার্থী ক্যাম্পে তাদের বসবাস ও মাসিক ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়। এরপরে বিভিন্ন সময়ে হাজারো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়, কিন্তু তারা আর নিবন্ধিত শরনার্থী হিসেবে নিজেদের লিপিবদ্ধ করতে নি। তাদের অন্ন, বস্ত্র বা বাসস্থানের কোন দায়-দায়িত্বও কেউ নেয় নি। কক্সবাজারের কুতুপালং, লেদা, নয়াপাড়া, জামতলী, পালংখালি, শামলাপুর প্রভৃতি স্থানে ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে তারা মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বেশ সহানুভুতিশীল ছিল বরাবর, কারণ রোহিঙ্গাদের সাথে ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আচারের দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলিমদের প্রচুর মিল রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সব সরকারই রোহিঙ্গাদেরকে অনেকটা সন্দেহ ও অবহেলার চোখে দেখে এসেছে। এ কারণে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসের মায়ানমারে নতুন করে রোহিঙ্গা নিপীড়ন ও নিধন শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এদেশের কোন সরকার রোহিঙ্গা শরনার্থীদের জীবনমান উন্নয়নের কোন উদ্যোগ নেয় নি। এ নীতির কারণ হল রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে শুরু করলে তা পাবার লোভে হয়তো বা আরো অনেক রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে আসতে পারে। তদুপরি, সরকার বিভিন্ন বিদেশি ও স্থানীয় দাতা ও সাহায্য সংস্থাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রোহিঙ্গাদের মধ্যে কাজ করা থেকে নিরুৎসাহিত করেছে।
তারপরও সরকার তিনটি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডাও (MSF), এ্যাকশন এ্যাগেইনস্ট হাঙ্গার (ACF) ও মুসলিম এইড ইউকে (MuslimAid UK)- কে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মাঝে সীমিতভাবে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেয়।
কিন্তু ২০১২ খ্রিস্টাব্দে রাখাইনে নতুন করে বৌদ্ধ-মুসলিম দাঙ্গা বাধলে দৃশ্যপট বদলে যায়। বাংলাদেশ সরকার সীমান্ত বন্ধ করে দেয় এবং নৌকাভর্তি করে দাঙ্গা থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে। সে বছরই সরকার উপরোক্ত তিনটি সংস্থাকে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে কাজ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কড়া সমালোচনা অগ্রাহ্য করে ও বিশ্বব্যাপী নিন্দা কুড়ালেও বাংলাদেশ তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে।
বাংলাদেশ সরকার এ সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই দিয়ে বলে যে আর্থ-সামাজিক দিকে দারিদ্রপীড়িত ও জনবহুল এদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া সরকার আর জানায় যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক ঘোষনাপত্রে অনুসাক্ষর করে নি, আর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানে আইনগতভাবে বাধ্য নয়।
রোহিঙ্গাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশ প্রকারান্তরে নিজের রক্তাক্ত শরনার্থী অতীত থেকেই দৃষ্টি সরিয়ে নিল। কেননা ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যা থেকে বাঁচতে প্রায় এক কোটি বাঙালি ভারতে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল। সে সময় যদি ভারত সরকার অসহায় ও নিপীড়িত মানুষের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করে না দিত, তাহলে এই বিপুল সংখ্যক লোকের ভাগ্যে কী ঘটতে পারত, তা আমরা আজ শুধু কল্পনাই করতে পারি।
রোহিঙ্গাদের প্রতি অবহেলা তাদের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনে আরো বেশি বিপর্যয় ডেকে এনেছে। জীবনের তাগিদে তারা বাধ্য হয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের জাল পাসপোর্ট নিয়ে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে দেশান্তরী হবার চেষ্টা করেছে। এ ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রাকালে বহু রোহিঙ্গা সাগরে ডুবে মারা গেছে এবং অনেকে মানব পাচারকারীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে বিদেশী সীমান্তে গণকবরে শয্যাশায়ী হয়ে রয়েছে।
কোন কোন রোহিঙ্গা চরম দারিদ্র্য নিষ্পেষণে বাধ্য হয়ে জঙ্গীবাদ, মাদক ও মানব পাচারসহ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়েছে। সুতরাং আজ রোহিঙ্গাদের চরম দুর্দশার জন্য প্রথমত ও প্রধানত মায়ানমার দায়ী হলেও বাংলাদেশেরও কিছুটা হলেও দায় রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদাসীনতা ও নিরাপদ দূরত্ব নীতি
২০১২ খ্রিস্টাব্দ অবধি রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময়ে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে এসেছে, কিন্তু বিষ্ময়করভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও গণমাধ্যম তার দিকে তেমন নজর দেয় নি এবং বহুলাংশে নীরবতার নীতি অবলম্বন করেছে। মুসলিম বিশ্ব ও প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ কখনোই জোরালোভাবে রোহিঙ্গা নির্যাতনের নিন্দা ও তাদের পক্ষ নেয় নি।
২০১৫ খ্রিস্টাব্দে যখন মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী জঙ্গলে মানব পাচারকারীদেও হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণকারী রোহিঙ্গাদেও গণকবর খুঁজে পাওয়া গেল, তার পরপরই দেশ দুটিতে পাচারবিরোধী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে বড় বড় সরকারি ও সেনা কর্মকর্তা যারা পাচারকারীদের সাথে যোগসাজশে মানব পাচারে জড়িত ছিল। এ সময় পাচারকারীরা বেশ কয়েকটি জাহাজে করে নিয়ে আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গা ও বেশ কিছু বাংলাদেশিকে সাগওে ভাসমান অবস্থায় রেখে পালিয়ে যায়, যাদের মধ্য থেকে অনেকে ক্ষুধার তাড়নায় ও নির্যাতনের কারণে মৃত্যুবরণ করে। পাশ্চাত্য মিডিয়া এ নির্মম ঘটনাকে “এশিয়ান বোট পিপল ট্র্যাজেডি” (Asian Boatpeople Tragedy) হিসেবে আখ্যা দেয় ও অবশেষে রোহিঙ্গা সংকট প্রবলভাবে বিশ্বের নজরে আসে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার সুষ্ঠু ও স্থায়ী সমাধানে তা যথেষ্ঠ ছিল না।
রোহিঙ্গা ট্র্যাজেডি পুনরায় বিশ্বের দৃষ্টিগোচর হয় ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ অক্টোবর, যখন আরসা জঙ্গীরা রাখাইন রাজ্যে নয়টি সীমান্ত চৌকিতে একযোগে আক্রমণ চালায়। এতে নয়জন সীমান্ত পুলিশ নিহত হয় ও জঙ্গীরা বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে নিয়ে যায়। এ হামলার প্রতিশোধ নিতে মায়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামসমূহে ব্যাপক হত্যাকান্ড, লুণ্ঠন, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ করে। প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
পাশ্চাত্য গণমাধ্যম ও সরকারসমূহ সুদীর্ঘকাল ধরে মায়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়ে এসেছে, যার কারণ মায়ানমারে সেনা শাসন অবসান, গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য তার বহু বছরের আপোষহীন সংগ্রাম।
কিন্তু দু:খজনকভাবে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবার পর থেকেই সু চি মুসলিম তথা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে উদাসীনতা ও নীরবতার নীতি অবলম্বন করেন। ২০১৬ ও ২০১৭-তে সেনাবাহিনী ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা নিধন ও নির্যাতন চালায়, কিন্তু সু চি তার সমালোচনা তো দূরের কথা, কোন বক্তব্যও দেন নি। বিভিন্ন সময়ে তার বক্তব্য থেকে জানা যায় তিনি রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আগ্রহী নন, বরং বিশ্ব গণমাধ্যমের সমালোচনা করে তিনি অভিযোগ করেন, যে তারা যে নির্যাতনের কথা বলছে তা অসত্য এবং এর মাধ্যমে তারা সংকটকে আরো উস্কে দিচ্ছে।
মায়ানমার সেনাবাহিনীর কড়া সমালোচনা করলেও বিশ্ব গণমাধ্যম ও পশ্চিমা সরকারসমূহ সু চির সমালোচনা করা থেকে বিরত ছিল। তাদের যুক্তি হল মায়ানমার সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও দেশটির নিয়ন্ত্রণ এখনো তাদের হাতেই, কারণ সেনাবাহিনী ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে সংবিধানে সংশোধনী এনে সংসদে ২৫% আসন তাদের নিজেদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে। তাছাড়া দেশটির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়- স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত ও প্রতিরক্ষা সেনাবাহিনীর হাতে। সুতরাং তাদের কথামতো সু চি সরকারপ্রধান হলেও তার আসলে তেমন কোন ক্ষমতা নেই, বরং সেনাবাহিনী বেসামরিক সরকারের পাশাপাশি আরেকটি সমান্তরাল সরকার চালায়, যার নিয়ন্ত্রণ সু চির হাতে নেই।
কিন্তু এ যুক্তিতে সু চির নীরবতা ও উদাসীনতা মেনে নেয়া যায় না। কারণ তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রধান, জনগণের বিপুল সমর্থন তার রয়েছে এবং পাশাপাশি তিনি পশ্চিমা সরকার ও মিডিয়ার আশির্বাদপুষ্ট।
তিনি সরাসরি সেনাবাহিনী সঙ্গে বিবাদে না জড়িয়েও রোহিঙ্গা নির্যাতন ও নিধন বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে পারতেন এবং রোহিঙ্গাদেও পক্ষে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কিছুই করলেন না। তার কারণ তিনি যেকোন মূল্যে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর এবং সেজন্য তিনি চিরশত্রু সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মেলাতেও পিছপা হবেন না। আর সু চির ব্যাপারে একথা ভুলে গেলে চলবে না যে তিনি নিজে একজন বার্মিজ, বৌদ্ধ এবং তা বাবা অং সান ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল। সুতরাং তিনি নিজেও বার্মিজ-বৌদ্ধ আধিপত্যবাদী (Burmese-Buddhist Suprimacist) ও সেনাবাহিনীর প্রতি সহানুতিশীল হবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও মায়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীকে দোষী সাব্যস্থ করতে যথার্থ উদ্যোগ নেয় নি। শক্তিশালী দুই প্রতিবেশী দেশ চীন ও ভারত তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলে মায়ানমার সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়াও মায়ানমারের ব্যাপারে নমনীয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপদ দূরত্বে থেকে নমনীয় বিবৃতি দিয়েছে ও কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ঘোষণা করেছে।
মুসলিম দেশসমূহ- যেমন, তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া মায়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার কড়া সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছে। তবে তাদের অবস্থান ও সমালোচনা কতটা সত্যিকার অর্থে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ থেকে, আর কতটা নিজ নিজ দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে রাজনৈতিক মুনাফা লাভের নিমিত্তে, সে প্রশ্ন ও সন্দেহ রয়েই যায়।
রোহিঙ্গাদেও দু:খ-দুর্দশার কাহিনী যুগ যুগ ধরে চির বহমান নাফ নদীর জলে মিশে চলেছে। হয়তো যদি নাফ কথা বলতে পারত, তবে সে জানাত রোহিঙ্গা জীবনের করুণ উপাখ্যান।
আজ এই আধুনিক বিশ্বে যদি রোহিঙ্গা নিপীড়ন ও নির্যাতনকে যদি আমরা রুয়ান্ডার তুতসি গণহত্যায় পরিণত হতে দেই, তবে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
ইতিহাসের নির্মম সত্য হল রোহিঙ্গাদের জন্মই যেন আজন্ম পাপ। আর তাই ভূ-রাজনৈতিক খেলাতেই (Geo-political game) নির্ধারিত হবে তাদের ভাগ্য, এবং তারা কোথায় ও কিভাবে বেঁচে থাকবে ও মৃত্যুবরণ করবে।।
রক রোনাল্ড রোজারিও: সাংবাদিক, লেখক ও বাংলাদেশ ব্যুরো প্রধান, ইউনিয়ন অব ক্যাথলিক এশিয়ান নিউজ (UCAN)
No comments:
Post a Comment