Jan 2, 2020

পথ চলতে ফিরে দেখা



গোড়ার কথা

ছোটবেলায় আমি বেশ লাজুক ও নিরীহ স্বভাবের ছিলাম সেটা হোক বাড়িতে, স্কুল বা বন্ধুমহলে। মনে পরে বাবা যদি কোনদিন কারো কাছে পাওনা টাকা ফেরত আনতে পাঠাতেন, তা চাইতে গেলেও আমার লজ্জা লাগতো। ক্লাস ফোরে পড়ার সময় আমাদের পবিত্র যীশু হৃদয় ধর্মপল্লীর (রাঙ্গামাটিয়া) সেবক দলে ভর্তি হই এবং ঐ বছরই কোন একদিন মিশায় সেবক হওয়ার পালা পরে। সেদিন ভয়ের চেয়ে লজ্জাই বেশি পেয়েছিলাম, আর তাই সেবকের কাজে ভুল করে ফেলেছিলাম। সাথে আমাদের বাড়ির এক বড় ভাই ছিল তাই কোন সমস্যা ছাড়াই পার পেয়ে যাই।

পরবর্তী জীবনে এই লাজুক ও নিরীহ ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, এবং এর পেছনে বড় অবদান আমার দীর্ঘ নয় বছরের (১৯৯৯-২০০৭) সেমিনারি জীবন। ক্লাস নাইন থেকে বি.এ. চূড়ান্ত বর্ষ পর্যন্ত ঢাকার তিনটি ধর্মপ্রদেশীয় সেমিনারিতে নানা অঞ্চলের সহপাঠী, বড় ও ছোট ভাইদের সঙ্গে কাটিয়েছি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও জেলার নানা মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে—বাঙ্গালি ও আদিবাসী। একাদিক্রমে বাংলাদেশের বাকি সাত ধর্মপ্রদেশের সাথে যোগসূত্র স্থাপনে আমার সেমিনারি জীবন একটি চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করেছে।

তবে, এ সত্ত্বেও, উত্তরবঙ্গ তথা রাজশাহী অঞ্চলে আমার ভাল কোন সংযোগ হয়নি। এর প্রধান কারণ সেমিনারি জীবনে আমাদের ব্যাচে এই এলাকার কোন সহপাঠী ছিল না। অন্যান্য ব্যাচে বেশ কয়েকজন বড় ও ছোট ভাই ছিল, বাঙ্গালি ও আদিবাসী। বাঙ্গালি যারা তাদের মুখের ভাষা ছিল হুবুহু আমাদের ভাওয়াল অঞ্চলের চলিত কথ্য ভাষা। তাদের কথা শুনে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম, যদিও জানতাম ঐ অঞ্চলের তিনটি বড় ধর্মপল্লীর (মথুরাপুর, বোর্ণী ও বনপাড়া) প্রায় সব বাঙ্গালি খ্রিস্টানই আমাদের ভাওয়াল অঞ্চলের অভিবাসী ও তাদের বংশধর। আমার বাবার দুই মামা ও এক মাসি যথাক্রমে পাবনার চাটমোহর ও নাটোরের শ্রীখণ্ডীতে কয়েক দশক পূর্ব থেকে বসবাস করে আসছেন। ছোটবেলায় দেখতাম বাবার মামাতো ও মাসতুতো ভাই-বোনেরা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। তবে সময়ের পরিক্রমায় যাতায়াত এবং সম্পর্ক উভয়েই ভাঁটা পড়ে যায়।
      
রাজশাহী-নাটোর-পাবনার বেলাভূমিতে

সেমিনারি জীবনে উত্তরবঙ্গ অঞ্চলে আমার তেমন ভাল বন্ধু গড়ে উঠেনি, তার কারণ আমার সমবয়সী বা সহপাঠী কাউকে পাইনি। ২০০৭ সালে সেমিনারি ছেড়ে এসে বেশ কয়েকজন বন্ধু, যুব সহকর্মী ও কলিগ পেয়েছি যারা অত্র অঞ্চলের। কিন্তু ২০১০ সালের আগে যমুনা নদী ওপারে উত্তরবঙ্গে যাওয়ার সুযোগ ঘটেনি। সে বছর জুন মাসে কাজের সুবাদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দশ দিনের সফরকালে যমুনা সেতু প্রথম বারের মত অতিক্রম করে সিরাজগঞ্জ, নাটোর, কুষ্টিয়া, মাগুরা ও খুলনা হয়ে বাগেরহাটের মংলা যাই। সে বছর অক্টোবর মাসে জাতীয় যুব কমিশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে রাজশাহী যাই ট্রেনে করে। ২৫তম জাতীয় যুব দিবস পরিচালনায় সহায়তা করতে তিনদিন রাজশাহীর খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্রে কাটাই, এবং সেটাই ছিল উত্তরবঙ্গে আমার প্রথম যাওয়া ও থাকা। সেই থেকে শুরু। কালক্রমে উত্তরবঙ্গে আমার নিয়মিত যাতায়াত ঘটেছে ও একদিন আত্মীয়তার শিকড় স্থাপিত হয়েছে। দিনে দিনে সে বন্ধন সুদৃঢ় হয়ছে।

২০১০ সালের শেষে এক কলিগ ও এক বন্ধুর পান-মাছ, নাম লেখা ও বিয়েতে বনপাড়া মিশনের বাহিমালি ও বনপাড়া গ্রামে বেশ কয়েক দিন ছিলাম। পরবর্তীতে, ২০১১ ও ২০১২ সালে এক বন্ধুর ভাই ও বন্ধুর নিজের বিয়েতে বোর্ণী মিশনে বেশ কয়েকদিন কাটাই। সেই সময়ে আমি সে অঞ্চলের খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রচলিত কিছু সামাজিক রীতিনীতি ও সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানের সংস্পর্শে আসি। যেমন, নাম লেখার দিন সমাজের সবার সামনে হবু জামাই ও বৌয়ের পরিচয়, প্রশ্নোত্তর ও সম্মতি প্রদান, বিয়ের দিন জামাই-বউ গির্জায় বিয়ের পর বাজনা সহযোগে বিভিন্ন বাড়িতে আশীর্বাদ নেয়া, নতুন বউকে নিয়ে দূরে গোসলের পানি আনতে যাওয়া, কুটুম্ব সাদর, দুধ-মিষ্টি পরিবেশন, বিবাহ ভোজে ডাল পরিবেশন ইত্যাদি। তবে সেগুলো আমার কাছে একদম নতুন ছিল না, কারণ আমি গাজীপুরের ভাওয়াল অঞ্চলের মানুষ এবং এসব ভাওয়াল অঞ্চলের বাঙ্গালি খ্রিস্টানদের ঐতিহ্য, যা কিনা মূলত অভিবাসী বাঙ্গালি খ্রিস্টানরা বহন করে এনেছেন ও এখনো ধরে রেখেছেন। খোদ ভাওয়াল অঞ্চলেই এসকল ঐতিহ্য আজ অনেকটাই বিলীন হয়ে গেছে, মূলত মানুষের অত্যধিক ব্যস্ততা ও ঢাকাভিত্তিক শহুরে সংস্কৃতির আগ্রাসনের ফলে। আবার অধুনা অনেকে এসব ঐতিহ্যকে “সেকেলে” বলে অবজ্ঞা করতেও ছাড়েন না।

মিলন ও সেতুবন্ধন   

যদিও উত্তরবঙ্গে অভিবাসী হওয়া বাঙ্গালি খ্রিস্টানদের অনেকে বেশ ভাল পরিমাণে জমি-জমা ও ভূসম্পত্তি ক্রয় ও অর্জন করেছেন, তবে ২০০১ সালে যমুনা সেতু চালু হওয়ার আগে উত্তরবঙ্গের অন্যান্য মানুষের মতো তাদেরও আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভাল ছিল না। যমুনা সেতু গোটা উত্তরবঙ্গের ব্যাপক উন্নয়ন ও অগ্রগতির চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচিত। এ উন্নতির জোয়ারে বাঙ্গালি খ্রিস্টানদেরও কপাল খুলে গেছে। তবে উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ খ্রিস্টান তাদের পিতৃপুরুষের ঐতিহ্য ও পারিবারিক-সামাজিক সারল্য ধরে রেখেছে। একদা ভাওয়ালের লোকজন উত্তরবঙ্গে বসবাসকারী নব্য ভাওয়ালদের আর্থিক অসঙ্গতি ও সামাজিক আচার-নিষ্ঠতাকে ঠাট্টা করত, অনেক সময় নিচু চোখে দেখত। কিন্তু দিন বদলে গেছে। শিক্ষা ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন বিবেচনায় এ অঞ্চলের লোকজন বহুদূর এগিয়ে গেছে। আর এটা তারা অর্জন করেছে তাদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যকে ধরে রেখে।

এসব কারণেই সাম্প্রতিককালে এক সময় ভাওয়াল অঞ্চল থেকে অনেকটাই ছিন্ন হয়ে যাওয়া নব্য ভাওয়াল জনগোষ্ঠী পুনরায় মিলন বন্ধনে যুক্ত হতে শুরু করেছে। যমুনা সেতু পরবর্তী যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং দেশজুড়ে মোবাইল ফোন সেবার প্রসার দূরত্বকে হটিয়ে দেশের দুই ভাওয়াল জনপদকে আরও কাছে এনেছে। গত দুই দশকে “বিয়ে” এই সেতু বন্ধনের একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এক সময় শুধু উত্তরবঙ্গের পিতা-মাতারা তাদের মেয়েদের ভাওয়ালে বিয়ে দিতে পারলে অনেক আনন্দিত বোধ করতেন, যেটা অনেক ক্ষেত্রে এখনো অব্যাহত আছে। তবে ইদানীং ভাওয়ালের অনেক পরিবার উপযুক্ত ছেলের সাথে তাদের মেয়েদের বিয়ে দেন। একদার এক তরফা বৈবাহিক ধারা এখন অনেকটা সাম্যাবস্থায়” চলে এসেছে। ২০১৫ সালে আমি নিজেও পাবনা চাটমোহর উপজেলাধীন ফ‌ৈলজানা মিশনে বিবাহসূত্রে যুক্ত হই। বিয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পারবারিক ও সামাজিক বন্ধনের দ্বারা উত্তরবঙ্গে আমার শিকড় বিস্তারের সিদ্ধান্তটি আমার বহু বছর ধরে একটু একটু করে এই অঞ্চলের সাথে নিবিড় সম্পর্কের চূড়ান্ত প্রকাশ।

সারা বছর বিভিন্ন সময়ে যমুনার ওপারে যাওয়া হয়, কখনো বেড়াতে, নিমন্ত্রণে কিংবা পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবে। উত্তরের সুবিস্তৃত সবুজ শ্যামল ভূমি, গ্রামের মানুষের সারল্য ও আতিথেয়তা, চিরাচরিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক আচার ও ঐতিহ্য হৃদয় ও মনকে আন্দোলিত করে এবং শহুরে জীবনের জটিলতা ও সংকট ভুলে থাকতে সাহায্য করে। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে বড়দিন উৎসব ও এক বিয়ের অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকদিন শ্বশুরালয়ে কাটিয়েছিলাম। অনেক বছরের মধ্যে সেটাই ছিল আমার অন্যতম সেরা বড়দিন। বড়দিনে বিভিন্ন আত্মীয় বাড়িতে বেড়ানো, আড্ডা, কীর্তন, ঐতিহ্যবাহী “বৈঠক” ও বিয়ে প্রভৃতি ছুটিটাকে স্মরণীয় করে রেখেছে।

আর এভাবেই দিনে দিনে, বিগত বছরগুলোতে পদ্মা-যমুনা-বড়াল নদীর অববাহিকায় নব্য ভাওয়াল জনপদ জীবনের একটি অংশে পরিণত হয়েছে এক সময় যে উত্তরবঙ্গ আমার কাছে একটি অজানা ও অচেনা স্থান ছিল, তা আজ আমার কাছে আপন মর্যাদায় নিজস্ব অবস্থান করে নিয়েছে।

সমাপ্ত

বিঃ দ্রঃ মূল লেখাটি ফৈলজানা মিশন খ্রিস্টান যুব সমিতি (চাটমোহর, পাবনা কতৃক প্রকাশিত "চিকনাই" ম্যাগাজিনের বড়দিন ও নববর্ষ ২০১৯ সংখ্যায় ছাপা হয়েছে।    

1 comment:

দক্ষিণ এশিয়ায় ভোটের রাজনীতি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়

Bangladeshi Christians who account for less than half percent of some 165 million inhabitants in the country pray during an Easter Mass in D...