মৌলভী বাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে একটি চা বাগানে সারাদিন কাজের শেষে চা শ্রমিক নারীরা ঘরে ফিরছেন রান্নার জ্বালানি সংগ্রহ করে (ছবি রক আর. রোজারিও)
আজকের এই দিনে আমার আদিবাসী বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজন সকলকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও সৌভাগ্যবান কারণ আমার এ জীবনে অনেক ভালো ভালো আদিবাসীর সংস্পর্শে এসেছি এবং অনেকের সাথে চিরস্থায়ী বন্ধুত্বে আবদ্ধ হয়েছি। আমার জীবন, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভান্ডারকে তারা নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে তাদের অনন্য জীবনধারা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দিয়ে। আমি যেমন তাদের ভালোবেসেছি, তেমনি তারাও আমাকে ভালোবেসেছে এবং কখনোই মনে হয় নি আমি ও তারা আলাদা কারণ আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি সম্প্রদায়ভুক্ত এবং তারা নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর। আমার জীবন অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি যে যদি সমান সুযোগ ও অধিকার দেয়া হয় তবে যেকোন সম্প্রদায়ের মানুষ একই রকমভাবে জীবনে উন্নতি করতে সক্ষম, আমার অনেক আদিবাসী বন্ধু তার প্রমাণ।দু:খজনক ব্যাপার হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার যথার্থভাবে স্বীকৃত নয়, এবং তাদের অধিকাংশ হতদরিদ্র, প্রান্তিক ও অনগ্রসর। কাগজে-কলমে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তাদের সমান অধিকার রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তা নেই। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হিসেবে তাদের সুরক্ষার জন্য যথার্থ কোন আইন ও নীতিমালা নেই, যার মাধ্যমে তাদের স্বতন্ত্র জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য টিকে থাকতে পারে। ভুমি ও সম্পত্তি দখলদার একদল সুযোগসন্ধানী সংখ্যাগুরু বাঙালি সম্প্রদায়ের দ্বারা প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত। অত্যাচারের শিকার আদিবাসীর জন্য বিচার সুদূরপরাহত এবং বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি ক্রমাগত তাদের আক্রমণকারীদের প্রণোদনা যুগিয়ে চলেছে। শেষ কথা কিন্তু ফেলনা নয়। আদিবাসীর এহেন দুদর্শায় তাদের নিজেরও কিছু দায় আছে। নিজেদের অধিকার আদায় ও শোষণের বিরোধিতায় আদিবাসীরা আজ দ্বিধাবিভক্ত। পাহাড়ী বনাম সমতল আদিবাসী, বৃহৎ বনাম ক্ষুদ্র আদিবাসী গোষ্ঠী, সরকারপন্থী বনাম সরকারবিরোধী প্রভৃতি দল ও উপদলে ব্যাপক অনক্যৈ আদিবাসীদের গ্রাস করেছে। একটি সম্প্রদায় অত্যাচারের শিকার হলে অন্য সম্প্রদায় নীরব থাকে, যতক্ষণ না তাদের কোন স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়। এ অনৈক্য ও বিবাদ আদিবাসী মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এবং এর সুবিধা ভোগ করে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার আদিবাসীবিরোধী অংশটি। অনেক আদিবাসী আজ তথাকথিত আধুনিকতার নামে নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক প্রভৃতিকে সারা বছর অগ্রাহ্য করে, আর বিশ্ব আদিবাসী দিবসে একদিনের আদিবাসী সাজার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। নিজের সম্পদ ও সংস্কৃতিকে যদি নিজে সম্মান, লালন ও তার জন্য লড়াই না করি, তবে আর কেউ তা করবে না, তা টিকেও থাকবে না। সবশেষে, বিশ্ব আদিবাসী দিবসে প্রত্যাশা করি বাংলাদেশের আদিবাসী মানুষের ইতিবাচক দিন বদল ঘটুক। বাঙালি ভাইবোনদের পাশাপাশি আদিবাসীদের সমান অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নে সমাজ ও রাষ্ট্রনেতাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। তাদের উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিক সমাজ ও রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা। আর সে লক্ষ্যে আদিবাসী সম্প্রদায়ে বৃহৎ ঐক্য গড়ে ওঠুক, কেননা অধিকার আদায়ের লড়াই চালিয়ে যেতে হবেই। অতীত যতো না হোক হতাশার, একটি সুন্দর আগামীর জন্য প্রত্যাশা ও কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রাখতেই হবে।।
|
No comments:
Post a Comment