“আমার
স্বামী যখন আমাকে নির্যাতন করে, তখন আমি মনে করি আমি সেটা আমার কোন ভুলের পরিণাম”—এমন
কথা বিবেকবান পুরুষ ও নারীর কাছে ভয়ংকর আঘাতের মত মনে হলেও বাংলাদেশে অনেক বিবাহিত
নারীর জীবনে এটাই এক কঠিন বাস্তবতা।
এ
বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি জরিপের ফলাফল দেখে দেশ
ও বিদেশের অনেকে, বিশেষ করে নারীবাদী ও নারী অধিকার কর্মীগণ বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
বিবিএস-র Multiple Indicator Cluster Survey 2019-র মতে, বাংলাদেশে প্রতি ৪ জন বিবাহিত
নারীর মধ্যে ১ জন অথবা শতকরা ২৫ ভাগ মনে করেন বিভিন্ন তুচ্ছ ভুল বা ক্ষুদ্র অধিকার
প্রয়োগ করার কারণেও স্বামীর নির্যাতন যৌক্তিক। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে, স্বামীর অনুমুতি
ছাড়া বাড়ীর বাইরে যাওয়া, সন্তানের যত্ন সঠিকভাবে করতে না পারা, স্বামীর সাথে তর্ক করা,
ভালভাবে রান্না করতে না পারা এবং স্বামীর ইচ্ছামত যৌন সম্পর্ক করতে রাজি না হওয়া।
বিবিএস-র
সাম্প্রতিক জরিপ কতটা বাস্তবসম্মত সেটা তর্কসাপেক্ষ, তবে বাংলাদেশ নারীর প্রতি সহিংসতা,
বিশেষ করে গৃহ নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিশ্বে অন্যতম শীর্ষে তাতে কোন সংশয় নেই। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (UNFPA) অর্থায়নে পরিচালিত বিবিএস-এর একটি জরিপ মতে, বাংলাদেশে
শতকরা ৮০ ভাগ বিবাহিত নারী তাদের জীবদ্দশায় স্বামী ও শ্বশুরবাড়ীর লোকদের দ্বারা বিভিন্ন
শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন।
বিশ্ব
জুড়েই গৃহ নির্যাতন নারীর প্রতি সহিংসতার মধ্যে অন্যতম। ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের পর
গৃহ জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থার মতে, গৃহ নির্যাতন বিশ্ব জুড়ে নারীর প্রতি সহিংসতার
অন্যতম কারণ এবং প্রায় ৩৫ শতাংশ নারী তাদের জীবদ্দশায় নানা প্রকার গৃহ নির্যাতনের শিকার
হয়ে থাকেন।
দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার মত রক্ষণশীল ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর প্রতি সহিংসতা একটি নিত্য নৈমিত্তিক ও বিয়োগান্তক বাস্তবতা।
আধুনিক
বিশ্বে অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে
নারীরাও তদের সম্মান, অধিকার ও ক্ষমতায়নের পথে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু এর অপরপিঠে
নারীর প্রতি অবমাননা ও সহিংসতা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও গর্হিত সামাজিক কলংক হিসেবে বিদ্যমান।
বাংলাদেশের
মত রক্ষনশীল ও পিতৃতান্ত্রিক দেশেও দুজন নারী ১৯৯১ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন
রয়েছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি ২০০৮ সাল থেকে পদে আসীন, তিনি গোটা
বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদী সরকার প্রধান হিসেবে বিবেচিত।
খ্যাতনামা
ফোর্বস পত্রিকার তালিকা মোতাবেক জার্মান চ্যান্সেলর আঞ্জেলা মেরকেল বিশ্বের অন্যতম
প্রভাবশালী সরকার প্রধান, যিনি ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতিকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে
শুধু পরিচালিত করেই ক্ষান্ত হন নি, পাশাপাশি গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে একতাবদ্ধ ও প্রাণবন্ত
রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছেন।
আফ্রিকার
দেশ রুয়ান্ডা এক সময় কুখ্যাতি অর্জন করেছিল গণহত্যার কারণে। সেদেশের পার্লামেন্টে আজ পুরুষ সদস্যের তুলনায় নারী সদস্যের সংখ্যা বেশি।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, এমনকি বাংলাদেশেও শিক্ষা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে মেয়েরা নিয়মিত ছেলেদের চেয়ে ভাল ফলাফল করছে। বিভিন্ন খাতে আমরা ক্রমশই কঠোর পরিশ্রমী, নিবেদিতপ্রাণ ও দক্ষ নারীদের অংশগ্রহণ দেখতে পাই। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, রাজনীতি, পুলিশ এবং বিচার বিভাগসহ সর্বত্র আজ নারীরা সগর্বে পদচারণ করছেন।
কিন্তু,
এতকিছুর পরেও নারীর প্রতি অবমাননা, অন্যায় ও সহিংসতা থেমে নেই। ঘর, রাস্তাঘাট, শিক্ষালয়
এবং কর্মস্থলসহ সর্বত্র নানাভাবে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে—যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ,
আত্মীয় দ্বারা নিপীড়ন (Incest), হত্যা, হয়রানি (Blackmail) বহু বিবাহ, বিবাহবহির্ভূত
সম্পর্ক, পারিবারিক বিরোধ ও ভূমি সংক্রান্ত বিবাদ, বিবাহ বিচ্ছেদ এবং নারীর ইচ্ছা,
সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও চলাফেরার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা।
সিংহ
ভাগ ক্ষেত্রে নারীর প্রতি অবিচার ও নির্যাতনের মূল কারণ হল নারীর প্রতি পুরুষের অন্যায্য
মনোভাব। অনেক পুরুষ নারীদের সমান অধিকার ও সম্মানের যোগ্যই মনে করেন না। পরিবার, সমাজ
ও রাষ্ট্রে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে তারা স্বীকার করতে চান না, বরং নারীর প্রতি
নির্যাতনকে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। এরূপ অন্যায় মনোবৃত্তি পুরুষশাসিত সমাজ
ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্র, বিচার ব্যবস্থা এমনকি শক্তিশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও
বদ্ধমূল হয়ে আছে, যা ক্রমাগত নারী ও মেয়েদের অবমূল্যায়নের বিপরীতে পুরুষের প্রাধান্য
ও আধিপত্য নিশ্চিত করে থাকে।
যে
সকল নারী নির্যাতনের শিকার হন এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন কিংবা নারী অধিকার নিয়ে
কথা বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের “খারাপ নারী” হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। শুধুমাত্র ধর্মীয়
উগ্রপন্থীরাই নয়, পাশাপাশি শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর পুরুষরাও এর কাতারে পড়েন।
অধিকাংশ
নারী নীরবে নির্যাতন সহ্য করেন, অশ্রুপাত করেন এবং সে সকল নির্যাতনের ঘটনা কোথাও প্রকাশিত
হয় না ও এসব সমস্যার কোন সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয় না। এর কারণ হল পুরুষতান্ত্রিক সমাজে
অনেকে মনে করেন নারীর প্রতি সহিংসতা “খারাপ নারীদেন সংশোধন করার হাতিয়ার।“ এই কারণে
বেশিরভাগ নির্যাতিত নারী মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করেন পাছে লোকে মনে করে “নিশ্চয় সে
কোন খারাপ কাজ করেছে!”
অনেক
ক্ষেত্রে দেখা যায় শ্বাশুড়ী ও ননদসহ শ্বশুর বাড়ীর লোকজন সে “খারাপ বউকে” শিক্ষা দেবার
কাজে হাত লাগান এবং তাতে পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ হয়ে পড়ে। তার মানে হল নারীর প্রতি
সহিংসতার ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী উভয়ে অনেক সময় এক কাতারে চলে আসে।
অনেক
নারী ও মেয়েরা চরম অত্যাচার সহ্য করে চোখের জল ফেলে নীরবে। তাদের এই নীরব অশ্রুপাত
শুধুমাত্র নির্যাতন থেকে মুক্তি না পাবার কিংবা বিচারহীনতার হতাশা থেকে নয়, বরং তাদের
মূল্য, মর্যাদা ও অধিকারের স্বীকৃতি না পাবার বেদনা থেকে।
উপযুক্ত
শিক্ষা ও স্বাধীনতা নারীর জীবন থেকে অবমূল্যায়ন ও অত্যাচারের বেদনা দূরীভূত করতে পারে,
কিন্তু তা-ই যথেষ্ট নয়। নারী এবং পুরুষ উভয়কে পরিবার ও সমাজে প্রচলিত নারী ও মেয়েদের
প্রতি কুসংস্কার ও পক্ষপাতের অপবিত্র দেয়াল ভেঙ্গে ফেলার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
পুরুষদের
উচিত নারীদেরকে অংশীদার (Partner) ও সহযোগী শক্তি হিসেবে ভাবতে ও দেখতে শেখা। এইরুপ
হৃদয়বৃত্তির পরিবর্তন সম্ভব যদি পুরুষ উপলব্ধি করতে পারে যে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের
সত্যিকার উন্নয়ন ও অগ্রগতি নারীর সমান অধিকার, সুযোগ ও মর্যাদা ব্যতীত অসম্ভব।
এর
পাশাপাশি তথাকথিত মডেলিং, পর্ণগ্রাফি এবং বাণিজ্যিক যৌন শিল্পসহ বিভিন্ন নেতিবাচক মাধ্যমে
নারীর সৌন্দর্য ও যৌনতার অন্যায্য, আপত্তিকর এবং অনৈতিকভাবে পন্যের মত ব্যবহার ক্রমশ
বন্ধ করার আন্দোলনে নারী ও পুরুষ উভয়কে শামিল হতে হবে।
মনে
হতে পারে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এতটা চাওয়া অনেক বেশি, কিন্তু আলোচনার টেবিল
এবং আন্দোলনের ময়দান থেকে এর কোন কিছুই বাদ দেয়ার মত নয়। নারীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার
হওয়ার পাশাপাশি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আজো বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য নারী ভোগবাদী জগতের
কঠিন শৃঙ্খলে বন্দী হয়ে আছে, যেখানে তাদেরকে ভোগ্য পণ্য হিসেবে গণ্য ও ব্যবহার করা
হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
আর
তাই ঘর থেকে শুরু করে সর্বত্র পুরুষকে নারীর জন্য সমতার পরিবেশ গড়ে তুলতে ব্রতী হওয়া
জরুরি। এক সময় এই শুভ আন্দোলন সর্বময় ছড়িয়ে পড়বে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের মননকে রুপান্তরে
ভুমিকা রাখবে।
নারীদেরকেও
তাদের ভূমিকা দায়িত্বশীলভাবে পালন করতে হবে। শিক্ষা ও নিজস্ব আয় (চাকুরি, ব্যবসা) আত্মনির্ভরশীল
হওয়ার পূর্বশর্ত। একই সঙ্গে তাদেরকে বিভিন্ন নারী অধিকার-সচেতন সংগঠনের সাথে যুক্ত
হওয়া দরকার যাতে তারা প্রয়োজনে নানা রকম সহায়তা পেতে পারে।
নারীদেরকে
নিজেদের কথা নিজেদের বলতে এবং দাবি-দাওয়া তুলে ধরা শিখতে হবে। তবে সেটা কোমর বেঁধে
সকল পুরুষের সাথে যুদ্ধ করার জন্য নয়, কিন্তু সংলাপ, আলোচনা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে
নিজেদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার আদায় করার নিমিত্তে।
পৃথিবী
বাস্তবিক অর্থেই আরও সুন্দর ও আনন্দময় হয়ে উঠবে যখন নারী ও পুরুষ একে অপরকে ভালবাসতে
ও শ্রদ্ধা করতে শিখবে যার যা রয়েছে তার কারণে, কে কোন লিংগ বা সম্প্রদায়ের সে কারণে
নয়। সেটা করা অবশ্যই সম্ভব যদি আমরা বিশ্বাস করি উপযুক্ত সুযোগ ও অধিকার পেলে নারীরাও
পুরুষের ন্যায় অনেক মহৎ কিছু করতে পারে।।
Original Article:
Great reflection Rock! We need to act from grassroots - from our heart!
ReplyDelete