Jun 25, 2023

জন্মভূমি ও শরণার্থী

Rohingya refugee in a camp in Bangladesh. (Photo: UNOPS)

বাড়ি সবসময় আমাদের হৃদয়ের কাছাকাছি একটি জায়গা, শুধুমাত্র এই কারণেই নয় যে আমরা সেখানে জন্মগ্রহণ করেছি, বড় হয়েছি এবং সেখানেই বাস করি। প্রকৃতপক্ষে বাড়ি বলতে ইট, পাথর, টিন, কাঠ বা বাঁশের কোন কাঠামো বোঝায় না। বাড়ি হলো সেই জায়গা যা ভালবাসা, মায়া এবং যত্নে লালিত।

আমাদের মাতৃভূমি বাড়িরই একটি বর্ধিত সংস্করণ, যা আমাদের দেশপ্রেমকে জাগ্রত করে। 

কোভিড-১৯ মহামারী এবং দীর্ঘ লকডাউনের কারণে আমরা ভালোবাসা এবং যত্নের বাইরেও মূলত জীবন বাঁচানোর জন্য বাড়িতেই দীর্ঘ বন্দিত্ব বরণ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। এ সময় হাজার হাজার অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশী অভিবাসী শ্রমিক চাকুরি ও আয় রোজগারের পথ হারিয়ে নিঃস্ব এবং হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল।

এহেন অবস্থা সত্ত্বেও শান্তি ও ভরসার বিষয় ছিলো যে বিশ্বের কোটি কোটি ঘর-বাড়িহীন ও দেশহীন মানুষের চেয়ে আমরা ভাগ্যবান। কারণ আর যাই হোক আমাদের ঘর-বাড়ি ও জন্মভূমি আছে, যা তাদের নেই। 

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-র তথ্য অনুসারে বিশ্বে প্রায় জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি ৮০ লাখের মতো।

মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়, এবং তাদের অনেক নামে ডাকা হয় - উদ্বাস্তু, রাষ্ট্রহীন, অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি, আশ্রয়প্রার্থী, শরণার্থী ইত্যাদি। তারা সবাই তাদের প্রিয় স্থান - বাড়ি এবং স্বদেশ থেকে বঞ্চিত।

বিহারী: দেশ যাদের পরিত্যাগ করেছে

১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের সময় হাজার হাজার উর্দুভাষী মুসলমান (বিহারী নামে পরিচিত) পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) চলে আসতে বাধ্য হয়।

উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতি একটি শক্তিশালী বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত করে। বিহারীদের ভাষা ও সংস্কৃতির কারণে অনেক বাঙালি তাদেরকে পশ্চিমাদের তাঁবেদার মনে করে এবং তাদের প্রতি ঘৃণা বৃদ্ধি পায়, যদিও তারা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলাম অনুসারী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কিছু বিহারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষ নেয় এবং কেউ কেউ যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়। এর শাস্তি হিসেবে অনেক বিহারীকে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের রক্ষা করতে দাতব্য সংস্থা রেড ক্রস এগিয়ে আসে। 

রেড ক্রস কয়েক লাখ বিহারীকে কয়েক ডজন অপরিসর, অস্বাস্থ্যকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ ক্যাম্পে রাখে। বিগত পাঁচ দশকেও সে ঘুপচি ক্যাম্প থেকে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে নি। যে পাকিস্তানকে তারা ভালোবেসেছে সে দেশও তাদের পরিত্যাগ করেছে এবং সেখানে ফেরার কোন আশাও আর নেই।

২০০৮ সালে, বাংলাদেশ হাইকোর্ট বিহারীদের নাগরিকত্ব প্রদানের অনুমতি দেয়। নতুন প্রজন্মের অনেকে জাতীয় পরিচয় পত্র পেয়ে ভোটারও হয়েছে। কিন্তু প্রায় ৩০০,০০০ বিহারীর সিংহভাগের জীবনের কোন পরিবর্তন বা উন্নতি আজো সুদূরপরাহত। সত্যিকার অর্থে কবে তাদের নিজের বাড়ি বা দেশ হবে সেকথা কারো জানা নেই।

বাস্তুহীন ও রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা

রোহিঙ্গা মুসলিমরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছে, তবুও তাদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে এবং তাদের মাতৃভূমি থেকে নির্মমভাবে বিতাড়িত হয়েছে।

২০১৬ এবং ২০১৭ সালে রাখাইনে ভয়ংকর সামরিক অভিযান থেকে বাঁচতে সাত লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে।

হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব এবং অন্যান্য দেশের শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেছে এবং অনাদরে বেড়ে উঠেছে। এসব দেশ তাদের অবাঞ্ছিত অতিথি এবং বোঝা হিসাবে বিবেচনা করে। বেশিরভাগ রোহিঙ্গা সত্যিই জানে আদৌ কোনদিন তারা নিজের বাড়ি বা মাতৃভূমির অধিকার লাভ করতে পারবে কিনা।

দেশভাগ এবং বিচ্ছিন্নতা

১৯৪৭ সালের ব্রিটিশ ভারত ভাগ প্রায় ২ কোটি উদ্বাস্তু তৈরি করেছিল - হিন্দু এবং শিখরা ভারতে এবং মুসলমানরা পাকিস্তানে। প্রায় ২০ লাখ মানুষ রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বা পথে মারা যায় অনাহারে ও রোগ-শোকে।

১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ, বেশিরভাগ হিন্দু, শরণার্থী হিসাবে ভারতে পালিয়ে যায়। যদিও তাদের বেশিরভাগই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে বাড়ি ফিরেছিল, একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভারতে রয়ে যায়।

বিহারি মুসলমানদের মতো পূর্ব পাকিস্তানের অনেক বাঙালি হিন্দু বৈষম্যের সম্মুখীন হয় এবং ভারতে উন্নত জীবন গড়তে ব্যর্থ হয়। ভারতের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে স্থাপিত ঘেটো-সদৃশ উদ্বাস্তু উপনিবেশে রোগে হাজার হাজার মানুষ বেঁচে আছে এবং মারা গেছে। তাদের বংশধরদের অনেকেই এখনো চরম দারিদ্র্যের মধ্যে নিমজ্জিত।

দেশহীন মানুষ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র

সাম্প্রতিক দশকগুলিতে, নির্যাতিত রোহিঙ্গা, তিব্বতি, শ্রীলঙ্কার তামিল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের হিন্দু সহ কয়েক হাজার উদ্বাস্তু ভারতের বিভিন্ন অংশে বসতি স্থাপন করেছে।

পাকিস্তানে প্রতিবেশী আফগানিস্তানে কয়েক দশকের যুদ্ধের কারণে প্রায় ১৫ লাখ শরণার্থী এবং বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় থেকে প্রায় ২০০,০০০ বাঙালি শরণার্থী করাচির ঘিঞ্জি বস্তিতে বসবাস করছে। পাকিস্তানের সামরিক শাসন এবং ইসলামিক সন্ত্রাস হাজার হাজার ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং উদারপন্থী মুসলমানকে উদ্বাস্তু হিসাবে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছে।

শ্রীলঙ্কার ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধ হাজার হাজার অভ্যন্তরীণ এবং বহিরাগত উদ্বাস্তু তৈরি করেছে এবং পুনর্বাসন এবং পুনর্মিলনের অভাবে তাদের মনের ক্ষত আজো তাজা রয়ে গেছে।

ভুটান তুলনামূলকভাবে সুখী এবং শান্তিপূর্ণ দেশ। তবে তারও অন্ধকার অতীত রয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে, ভুটান সহিংসভাবে প্রায় ১০০,০০ লোটশাম্পাকে (জাতিগত নেপালি) বহিষ্কার করে, তাদেরকে শরণার্থী হিসেবে নেপালে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। অনেকে অন্যত্র পুনর্বাসিত হয়েছে কিন্তু অধিকাংশই এখনও ক্যাম্পে বসবাস কর।

সুতরাং আজ যাদের বাড়ি, সমাজ ও জন্মভূমি রয়েছে তারা সেসব ভাগ্যবিপর্যয়ের শিকার কোটি কোটি অসহায় ভিটেমাটিহীন ও দেশহীন মানুষের তুলনায় কতই না সৌভাগ্যবান। নিজের বাড়ি ও মাতৃভূমি থাকা যে বিরাট এক আশীর্বাদ তা বলাই বাহুল্য। তাই পরিবার, সমাজ ও জন্মভূমির কাছ থেকে কি পেলাম বা পেলাম না তা নিয়ে মাথা না কুটে সমাজ এবং দেশের মঙ্গলে এবং উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রত্যেকেরই জীবনের ব্রত হওয়া উচিত।।

Original Article: Home, homeland and aliens

No comments:

Post a Comment

দক্ষিণ এশিয়ায় ভোটের রাজনীতি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়

Bangladeshi Christians who account for less than half percent of some 165 million inhabitants in the country pray during an Easter Mass in D...