ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া দেশগুলোতে বিয়ে মানেই হলো সপ্তাহজুড়ে নানা অনুষ্ঠানের অপ্রয়োজনীয় আতিশয্য (Photo: Unsplash) |
করোনা মহামারীকালে এমন অনেক সংক্ষিপ্ত ও অনাড়ম্বর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সাধারণ অবস্থায় এমন বিয়ে একপ্রকার অকল্পনীয় বটে।
ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া দেশগুলোতে বিয়ে মানেই হলো সপ্তাহজুড়ে নানা অনুষ্ঠানের অপ্রয়োজনীয় আতিশয্য। এসব অনাবশ্যক বাগাড়ম্বরের সাথে দেশীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির কোন মিল নেই বললেই চলে।
এহেন জৌলুসপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতার উল্টোপিঠে আমরা দেখতে পাই দক্ষিণ এশিয়ার আর্থ-সামাজিক দূরাবস্থা যেখানে বিশ্বের মোট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তিন ভাগের এক ভাগ বাস করে যাদের মাথাপিছু দৈনিক আয় দুই মার্কিন ডলারেরও নিচে।
ভারতীয় ধনী ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিরা বিলাসবহুল বিয়ের অনুষ্ঠানকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে বর্তমানে “বিগ ফ্যাট ইন্ডিয়ান ওয়েডিং” (Big Fat Indian Wedding) কথাটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে
২০১৮ সালে ভারতের সবচেয়ে ধনী শিল্পপতি মুকেশ আম্বানি তার মেয়ে ইশা আম্বানির বিয়েতে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে এ যাবত কালের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন।
বিলাসবহুল এহেন বিয়ের নজির পাকিস্তানেও রয়েছে। গবেষক আমিনা মহসিন ২০১৮ সালে লিখেছেন যে সে দেশে রেওয়াজ (ঐতিহ্য) রক্ষার নামে বিয়ের নানা পর্বের অনুষ্ঠানে ৭০ লক্ষ রুপির (৪২,০০০ মার্কিন ডলার) পর্যন্ত খরচ হয়ে থাকে।
বাংলাদেশেও একইভাবে সাম্প্রতিক সময়ে বিলাসী বিয়ের ধারা চালু হয়েছে। এর মানে নয় যে মানুষ এখন তাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিয়ে অধিক সচেতন এবং এসব সামাজিক রীতি-নীতিকে নিষ্ঠা সহকারে পালন করতে ইচ্ছুক। মোদ্দাকথা হলো, লোক দেখানো বিলাসী বিয়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় শামিল হওয়াটা অনেকটা হাল ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে বিয়ের অনুষ্ঠানে বাড়ি দেখা, এনগেজমেন্ট, বিয়ে, বৌভাত এবং বিবাহোত্তর সম্বর্ধনাসহ কমপক্ষে চার-পাঁচটি ধাপ থাকে। এত সব পালন করতে গিয়ে বর ও কনের পরিবারকে সামাজিকতা রক্ষার নামে কম করে হলেও তিন থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করতে হয়। পরিবার যদি বিত্তশালী হয় তবে ব্যয়ের মাত্রা পাঁচ গুণের বেশিও হতে পারে।
২০১৭ সালে এক ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ তার একমাত্র ছেলের বিয়েতে চার হাজারের বেশি লোককে দাওয়াত করে পত্রিকায় খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন। খবরে প্রকাশ যে তিনি বিরাট আয়োজন করে তার এলাকার মানুষের কাছে তার ছেলের বিয়ের ঘটনা চিরস্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছিলেন।
আবেগের বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ
এশিয়া মহাদেশের ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিপাইন এবং পূর্ব তিমুর ছাড়া আর সর্বত্রই খ্রিস্টানরা ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। কিন্তু তারাও ব্যয়বহুল বিয়ের গড্ডালিকা প্রবাহের বাইরে নয়।
আইমানি ফিলিপিন্সের তথ্য অনুসারে ফিলিপাইনে বিয়ের গড় ব্যয় ১১৩,১২০-৪৪৩,১৫০ পেসো (২,২৫০-৮,৮৪০ মার্কিন ডলার)। এ ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে চার্চের বিয়ের লাইসেন্স এবং বিভিন্ন ডকুমেন্ট যার মূল্য ৩,১৫০ পেসো এবং চার্চে বিয়ের ফি যার খরচ ৭,০০০-২৫,০০০ পেসো।
ফিলিপাইনের মতো খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে যেখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৭ ভাগ দরিদ্রসীমার নিচে বাস করে, সেখানে এমন ব্যয়বহুল বিয়ের রীতি একাধারে অখ্রিস্টীয় এবং পরিহাসমূলক। এহেন পরিস্থিতিতে অনেক দরিদ্র মানুষ চার্চে বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে না। চার্চ কর্তৃপক্ষ এবং সরকারকে এমন দরিদ্রবিরোধী এবং অগ্রহণযোগ্য নীতি বাতিল করার উদ্যোগ নিতে হবে।
একেকটি বিয়ে জীবন, ভালোবাসা এবং অফুরান সম্ভাবনার উৎসব হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু এশিয়ার ক্রমবর্ধমান পুঁজিবাদী এবং প্রতিযোগিতামূলক সমাজ ব্যবস্থায় তা ক্রমশই বিত্তের জৌলুস এবং তথাকথিত ইমেজ তৈরির উপলক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজকাল বিবাহিত যুগলের দাম্পত্য জীবন যাতে সুখী এবং সফল হয় সেজন্য যেরূপ “আবেগের বিনিয়োগ” করা প্রয়োজন তার ততটুকু করা হয় সেটি নি:সন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ। বর্তমানে এশিয়া বিভিন্ন দেশে ক্রমবর্ধমান দাম্পত্য কলহ, বিচ্ছেদ এবং পারিবারিক ভাঙ্গনের দিকে তাকালে আমরা একথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি বিয়ে অনুষ্ঠানের চাকচিক্যের ফুলঝুড়ি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সময়, অর্থ এবং শক্তি অপচয় ব্যতীত কিছুই নয়।
পারিবারিক সম্মান ও মর্যাদার নামে বিয়েতে এককালীন দামী পোশাক, স্বর্ণালংকার, দামী প্রসাধনী, বিলাসী খাদ্য, পানীয় ও মদ, ছবি, ভিডিও এবং আধুনিক সংগীত ও নৃত্য আয়োজনের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা এক প্রকার নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিয়েকে একটি রুপকথার আয়োজনে পরিণত করার উদ্দেশ্য থেকে বিশ^ব্যাপী কোটি কোটি ডলার মূল্যমানের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট শিল্প গড়ে ওঠেছে।
২০১৯ খ্রিস্টাব্দের এক সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ইংল্যান্ডের অভিবাসী বাংলাদেশিরা বিয়েতে গড়ে ৩৭,৩৫২ মার্কিন ডলার খরচ করে থাকে। কিন্তু তাদের মধ্যেই বিবাহ বিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি।
প্রায়ই বিলাসবহুল বিয়ের পক্ষে যুক্তি হিসেবে কৃষ্টি ও সংস্কৃতির দোহাই দেয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর মূল কারণ হলো অর্থহীন জৌলুসের নগ্ন প্রদর্শন এবং তথাকথিত আত্মতুষ্টি।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রায়ই দেখা যায় মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তাদের ছেলে ও মেয়ের বিয়ের জন্য বছরের পর বছর ধরে অর্থ জমা করে, অথবা ব্যাংক ও সমবায় সমিতিসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করে। ঋণের জালে জর্জরিত হওয়ার যন্ত্রণা অনেক পরিবারকে বছরের পর বছর সহ্য করতে হয় এবং অনেক পরিবার অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বহু নজির রয়েছে।
২য় ভাটিকান মহাসভার শিক্ষা অনুসারে ক্যাথলিক মন্ডলী স্থানীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে এবং এ কারণে বিয়ে সামাজিক রীতি-নীতিতে তেমন একটা হস্তক্ষেপ করে না, এমনকি বিয়ে পারিবারিক ব্যয়ে বিষয়েও খুব বেশি নজর দেয় না।
তবে প্রায় এক দশক আগে বাংলাদেশের কয়েকটি ক্যাথলিক ডায়োসিস বিয়ে সংক্রান্ত বিধিমালা জারি করে এবং বিধি-নিষেধ অমান্য করলে জরিমানার বিধান চালু করে। ঐতিহ্যেও দোহাই দিয়ে বিষয়টি নিয়ে অনেকে আপত্তি তোলে, কিন্তু তা ধোপে টেকে নি। এ বিধিমালা চালুর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত হৈ-হুল্লোড় এবং মদ্যপানের ফলে সৃষ্ট ঝগড়া-বিবাদ বন্ধ করা। কিন্তু প্রত্যাশার বিপরীতে প্রাপ্তি যৎসামান্যই। দেদারসে মদ্যপান, মাতলামি এবং ঝগড়া-বিবাদ গ্রামাঞ্চলের খ্রিস্টান বিয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সম্প্রতি একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির সঙ্গে আলাপকালে তিনি এক বিয়ে বাড়িতে মদের পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয়ের কথা তুলে ধরে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “মদ পরিবেশনে যে পরিমাণ ব্যয় হয়েছে তাতে একটা গরিব পরিবার সারা বছর চলতে পারতো।”
এশিয়ার বৃহত্তর সমাজ ব্যবস্থায় বিবাহের এহেন রীতি-নীতি পরিবর্তনে প্রভাব বিস্তার করতে চার্চের তেমন কিছু করার নেই, আর তাই খুব বেশি প্রত্যাশা করাও উচিত নয়। কারণ একমাত্র ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া ও পূর্ব তিমুর ব্যতীত সর্বত্রই খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘু। কিন্তু তা সত্ত্বেও চার্চ অন্তত ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের বিলাসী বিয়ে থেকে বিরত রাখতে একটি সার্বজনীন নীতিমালা গ্রহণ করতে পারে।
কিভাবে এ চলমান বিয়ের নামে আতিশয্য পরিহার করা যায় এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার জন্য এবং তাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তনে চার্চের নেতৃবৃন্দকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। ক্যাথলিক প্যারিশ এবং চার্চভিত্তিক সংগঠনগুলোকে এক্ষেত্রে কাজে লাগাতে যেতে পারে। বিয়েতে বিলাসীতা পরিহারের বিষয়টি ক্যাথলিক বিবাহ প্রস্তুতির ক্লাসে যুক্ত করা উচিত। খ্রিস্টানরা যদি বিয়ে মাধ্যমে তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চায়, তবে সেটা তারা করুক অর্থ জমিয়ে গরীবদের দান করার মাধ্যমে।
বহু যুগ ধরে যে বিবাহ রীতি চালু রয়েছে, তার পরিবর্তন করা সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু চার্চ এবং খ্রিস্টান সমাজকে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে এবং প্রচেষ্টা চালাতে হবে। করোনা মহামারী আমাদের বাধ্য করেছে এমন অনেক কিছু করতে যা আমরা কোনদিন কল্পনাও করিনি এবং এমন কিছু গ্রহণ করতে যা কোনদিন গ্রহণ করার মতো মনে হয় নি।
আমরা যদি চাই তবে মহামারী আমাদেরকে জাঁকজমকের পরিবর্তে সাধারণ বিয়েকে গ্রহণ করতে শিক্ষা দিতে পারে।
-০-
রক রোনাল্ড রোজারিও ঢাকাভিত্তিক সাংবাদিক, লেখক এবং আন্তর্জাতিক ক্যাথলিক সংবাদমাধ্যম ইউনিয়ন অব ক্যাথলিক এশিয়ান নিউজের (UCAN) উপ-সম্পাদক। মূল প্রবন্ধটি ইংরেজি ভাষায় ইউকান ওয়েবসাইটে ২০২০ সালের ২৪শে জুন প্রথম প্রকাশিত হয়। সর্বসত্ত্ব লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত।
মূল লেখার লিংক: Time to say adieu to extravagant weddings
No comments:
Post a Comment