Bangladeshi Christians who account for less than half percent of some 165 million inhabitants in the country pray during an Easter Mass in Dhaka on April 8, 2007. (Photo: AFP) |
ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান - একদার ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি জনবহুল দেশে নির্বাচনী দামামা বেজে উঠেছে। এ বছরের মধ্যে তিনটি দেশেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। এর জের ধরেই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো চিরাচরিত সাংঘর্ষিক রাজনীতি, পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুড়ি এবং দমন-পীড়ণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে।
বিশে^র আটশ কোটির বেশি জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের বসবাস দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে। কিন্তু দরিদ্র সীমার নিচে বাসকারী পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক বাস করে এ অঞ্চলে। সাত দশকের বেশি আগে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও এ বিপুল দরিদ্র এবং মৌলিক চাহিদা পূরণে অক্ষম মানুষের জীবনের চরম দুর্দশার অন্যতম প্রধান কারণ হলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সত্যিকার গণতন্ত্রের অভাব, রাজনৈতিক দলগুলোর স্বেচ্চাচারী এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সীমাহীন দুর্নীতি এবং সমাজের তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত দরিদ্র, অবহেলিত এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে নীতিমালা এবং কার্যক্রমের ঘাটতি।
দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশেই জাতিগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সমাজের দরিদ্র, অবহেলিত, নির্যাতিত এবং ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠীর অন্তভুক্ত। ভারতে যেমন মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং আদিবাসী সম্প্রদায় অবহেলা এবং নিপীড়ণের শিকার, তেমনি পাকিস্তানে খ্রিস্টান, হিন্দু এবং উপজাতি জনগোষ্ঠী অধিকতর বঞ্চিত এবং নির্যাতিত। নেপালে সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ও মুসলিম, শ্রীলংকায় হিন্দু, মুসলিম এবং খ্রিস্টানরা একইভাবে অবহেলিত এবং পশ্চাৎপদ।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে হিন্দু এবং আদিবাসী সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি নিষ্পেষণের শিকার হয় এবং এর প্রধান কারণ ভূমি বিরোধ ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিদ্বেষ। এদেশের খ্রিস্টান ও বৌদ্ধদের সংখ্যা অতি নগন্য, আর তাই ভোটের রাজনীতিতে তারা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। সে কারণে তাদেরকে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়, মৌলবাদী গোষ্ঠী কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর রোষানলে তেমন পড়তে হয় না। একইভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নানাভাবে অবহেলিত, পশ্চাৎপদ, নির্যাতিত এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতাবলয়ের বাইরে রয়ে গেছে।
এশিয়াতে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশির বসবাস। অঞ্চল ভেদে মুসলিম, বৌদ্ধ এবং হিন্দু সম্প্রদায় বিভিন্ন দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এশিয়ায় বিশে^র দুইশ কোটির বেশি খ্রিস্টানের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশের বাস। শুধুমাত্র ফিলিপাইন এবং পূর্ব তিমুর খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়াতেও খ্রিস্টানরা সংখ্যাগুরু (৩০%), যদিও দেশটির ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ কোন আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালন করে না। এ তিনটি দেশ ব্যতিত এশিয়ার সকল দেশেই খ্রিস্টানরা নগন্য সংখ্যালঘু এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিবর্জিত। দক্ষিণ এশিয়াতেও একই চিত্র লক্ষণীয়।
বিশে^র বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ এবং সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারত। ১৪০ কোটির অধিক জনসংখ্যার দেশে হিন্দুরা ৮০%, মুসলিমরা প্রায় খ্রিস্টানদের সংখ্যা প্রায় দুই কোটির মতো। ভারতের ২৮ টি রাজ্য এবং কেন্দ্র শাসিত ৮ টি অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খ্রিস্টানদের বসবাস। বাংলাদেশের মতো ভারতের খ্রিস্টানদের প্রায় অর্ধেক আদিবাসী এবং সামাজিকভাবে অনগ্রসর দলিত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। উত্তর ভারতের ছোট রাজ্য এবং আদিবাসী অধ্যুষিত নাগাল্যান্ড (৮৭%), মিজোরাম (৮৬%) ও মেঘালয়ে (৭৫%) খ্রিস্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কেরালাতে মোট জনসংখ্যার ১৮%, মণিপুরে ৪২%, অরুণাচল প্রদেশে ৩০%, গোয়া রাজ্যে ২৫%, আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ২১%, পন্ডিচেরীতে ৬.৩% এবং তামিল নাড়ুতে ৬.২% খ্রিস্টান।
ভারতের খ্রিস্টানরা সংখ্যায় নগণ্য হলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক উন্নয়নে তাদের অবদান অবিস্মরণীয়। কিন্তু নির্মম পরিহাস হলো কিছু খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চল বাদে ভারতে অনেক জায়গায়ই তারা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অবহেলিত এবং নির্যাতিত। খ্রিস্টানরা উদারপন্থী, বাম, প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে বরাবর সমর্থন করে এসেছে। কিন্তু আখেরে তাদের তেমন কোন লাভ হয় নি। কেন্দ্রে দীর্ঘকাল কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলেও অনগ্রসর খ্রিস্টান আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের উন্নয়ন সাধন এবং বৈষম্য বিলোপে উল্লেখ করার মতো কিছু করে নি।
২০১৪ এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকে সংখ্যালঘু মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের উপর মৌলবাদী এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত শত শত হামলা এবং মামলা ঘটনা ঘটেছে, তাদের বাড়ি-ঘর এবং উপাসনালয় ভাংচুর করা হয়েছে এবং সরকারের সমালোচক এবং মানবাধিকার কর্মীদের আটক এবং হেনস্থা করা হয়েছে। ২০২১ সালে বৃদ্ধ জেজুইট পুরোহিত এবং উন্নয়ন কর্মী স্ট্যান স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, জেলে বন্দীদশায় অবহেলা এবং হয়রানি শেষে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া - মোদী সরকারের হিন্দু তোষণ এবং সংখ্যালঘু নিপীড়ণের প্রতি সমর্থনের জ¦লন্ত উদাহরণ।
ভারতের ১১ টি রাজ্যে চরম নিগ্রহমূলক ধর্মান্তর প্রতিরোধ আইন বলবৎ আছে। এসব রাজ্যের অধিকাংশে বিজেপি এবং বিজেপি সমর্থিত দল ক্ষমতায়। ধর্মান্তর প্রতিরোধ আইনের অপব্যবহার করে মৈালবাদী হিন্দুরা মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের ব্যাপক হয়রানি এবং জেল-জুলুমের মুখোমুখি করে চলেছে। বিগত তিন বছরে বিজেপি শাসিত সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশে প্রায় ৪০০ খ্রিস্টানকে আটক করে জেলে পাঠানো হয়েছে। ১৮০-র বেশি মামলার সবই ভুয়া এবং হয়রানিমূলক।
সুতরাং ভোটের রাজনীতিতে অধিকাংশ জায়গায় ভারতের খ্রিস্টানরা নিষ্পেষিত এবং অবহেলিত। ভারতে খ্রিস্ট ধর্মের ইতিহাস হাজার বছরের হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতির মাঠে তাদের আজো দয়ার পাত্র হিসেবেই দেখা হয়।
১৭ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে ৯০ শতাংশের বেশি ইসলাম ধর্মের অনুসারী, ৮% হিন্দু এবং বাকিরা বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানসহ অন্য ধর্মের অনুসারী। বাংলাদেশের হিন্দুরা বিভিন্ন সময়ে মৌলবাদী এবং ডানপন্থী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হয়েছে এবং প্রায়ই ভূমি বিরোধ এবং রাজনৈতিক কারণে অত্যাচারের শিকার হয়। এসব সত্ত্বেও বাংলাদেশে হিন্দুরা তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, দক্ষতা এবং নেতৃত্বগুণে সমাজ ও রাষ্ট্রে উচ্চপদে আসীন হতে সক্ষম হয়েছে। অভিজাত হিন্দু শ্রেণী সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার ভরকেন্দ্র অবধি স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারে। বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের টানা তিন আমলে একাধিক হিন্দু নেতা মন্ত্রী হয়েছেন এবং প্রায় ২০ জনের বেশি এমপি নির্বাচিত হতে সক্ষম হয়েছেন। আগামী জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে আওয়ামী লীগ ২০ জনকে মনোনয়ন দিয়েছে, যার মধ্যে ১৮ জনই হিন্দু। বিরোধী দল বিএনপি আওয়ামী লীগের অধীনে এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতিত ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বেও হিন্দুরা রয়েছেন। জাতীয় এবং ভোটের রাজনীতিতে হিন্দু প্রভাব এবং গুরুত্বের কথা তাই বলাই বাহুল্য।
বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায় সংখ্যাগত দিক থেকে যেমন নগন্য, তেমনি তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিও নেই। সে কারণে বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায় তুলনামূলক অনেক কম নির্যাতনের শিকার। বাংলাদেশে সর্বসাকুল্যে ছয় লাখের মতো খ্রিস্টানের বাস, জনসংখ্যার হার অর্ধ শতাংশেরও কম। খ্রিস্টানদের প্রায় অর্ধেক নানা আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। তুলনামূলকভাবে খ্রিস্টানদের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা কম, যদিও শতাধিক সমবায় প্রতিষ্ঠানে খ্রিস্টানরা গণতান্ত্রিক ভাবে নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। বাস্তবতা হলো খ্রিস্টানদের নেতৃত্বের দৌঁড় সমবায় এবং আঞ্চলিক রাজনীতি পর্যন্ত, জাতীয় রাজনীতিতে তাদের টিকে থাকার যোগ্যতা এবং ইচ্ছা উভয়েরই অভাব রয়েছে।
বিগত পাঁচ দশকের বেশি সময়ে বাংলাদেশি খ্রিস্টানদের মধ্যে একমাত্র গারো আদিবাসী এবং আওয়ামী লীগ রাজনীতিবিদ প্রমোদ মানকিন (১৯৩৯-২০১৬) ৪ বার এমপি নির্বাচিত এবং একমাত্র সরকারী মন্ত্রী হতে পেরেছেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে জুয়েল আরেং তার আসনে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি হয়েছেন। বিগত সংসদে সংরক্ষিত আসনে এডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার প্রথম খ্রিস্টান নারী এমপি হিসেবে মনোনীত হন। বলাই বাহুল্য খ্রিস্টানদেরকে অনেক দয়া করে দুটো এমপি পদ দেয়া হয়েছে। জাতীয় সংসদের দুই বা তিনটি আসন ছাড়া আর কোথাও খ্রিস্টানদের ভোট প্রার্থীর জয় বা পরাজয়ে কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং উন্নয়ন খাতে খ্রিস্টানদের অনেক অবদান থাকা সত্ত্বেও তারা সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাবলয়ের বাইরে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে -- এটাই চরম বাস্তবতা।
বিভিন্ন সময়ে খ্রিস্টানদের উপর হামলার কোন সুষ্ঠু বিচার হয় নি। ২০০১ সালে বানিয়ারচর গির্জায় রবিবার খ্রিস্টযাগ চলাকালে জঙ্গি হামলায় ১০ জন ক্যাথলিক মারা যায়। বাইশ বছর পেরিয়ে গেলেও এ হামলার বিচারকাজ এখনো শুরুই হয় নি। ২০১৬ সালে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ বাগদা ফার্মে খ্রিস্টান আদিবাসী সাওতালদের হামলা করে উচ্ছেদ করা হয় এবং তাতে তিনজন সাওতাল মারা যায়। ২০১৪ সালে সাওতাল ক্যাথলিক এবং গোবিন্দগঞ্জের সহকারী ভূমি কমিশনার অভিদিও মারান্ডি রহস্যজনকভাবে মৃত্যু বরণ করেন। অনেকের বিশ^াস স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমি দস্যুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কারণে তাকে কৌশলে মেরে ফেলা হয়েছে। ভোটের রাজনীতিতে খ্রিস্টানদের আবেগ-অনুভূতির কতটুকু দাম আছে তা সহজেই বোধগম্য।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে মুসলিমদের জন্য আলাদা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম হয়। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্য এবং নিষ্পেষণের জের ধরে ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ নামে আরেকটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় ঘটে। বর্তমানে পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশ এবং একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ২৩ কোটির বেশি মানুষের বাস। মোট জনসংখ্যার ৯৬ শতাংশের বেশি মুসলিম, ২% হিন্দু এবং ১.২৭% খ্রিস্টান। দেশটির ১১ লাখের বেশি খ্রিস্টানের অধিকাংশ পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশে বাস করে।
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের জের ধরে ভারতে পালিয়ে যাওয়া হাজার হাজার হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় “শত্রু সম্পত্তি আইন” নামক এক কালো আইনের মাধ্যমে। স্বাধীন বাংলাদেশেও ২০১০ সাল পর্যন্ত এ আইন “অর্পিত সম্পত্তি আইন” নামে চালু ছিলো। এ আইন বাতিল করা হলেও আইনী জটিলতা, দখলদারিত্ব এবং ভয়ভীতির কারণে বহু ভুক্তভোগী তাদের সম্পত্তি এবং জমি আজো ফেরৎ পান নি। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় পাকিস্তানে ২১% শতাংশ হিন্দু থাকলেও তা কমতে কমতে বর্তমান বাংলাদেশে ৮% হিন্দু রয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক-রাজনৈতিক নিপীড়ণ ছাড়াও এ বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর দেশত্যাগ করে ভারতে অভিবাসী হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে এ কালো আইনকে অনেক গবেষক দায়ী করেছেন।
পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হক তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ধর্মকে ব্যাপক অপব্যবহার করেন। তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল করার অনুমোদন এবং সহায়তা করেন। সে সময় থেকে পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় মদদে জঙ্গিবাদের উত্থান শুরু। তার আমলে পাকিস্তান দন্ডবিধি সংশোধন করে ভয়ংকর দুটি ধারা যুক্ত করা হয়, যার মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম এবং মহানবী হযরত মোহাম্মদকে কটুক্তি করা শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়। এ আইন ব্লাসফেমি আইন হিসেবে পরিচিত। এ ভয়ংকর আইনের অপব্যবহার করে শত শত মুসলিম, বিশেষ করে আহমদিয়া এবং হাজারা সম্প্রদায়, খ্রিস্টান এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে মামলা এবং হামলা হয়েছে এবং অনেককে বিচারবহির্ভূতভাবে মেরে ফেলা হয়েছে।
এ বছরের ১৬ আগস্ট পাঞ্জাব রাজ্যের জারানওয়ালা শহরে কোরান অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে মুসলিমদের দাঙ্গায় ২২ টি গির্জা এবং ৮০টির বেশি খ্রিস্টানদের বসত-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট করা হয়েছে। ইতিপূর্বের এরূপ অসংখ্য হামলার ন্যায় সর্বশেষ দাঙ্গারও কোন বিচার হবে না এবং হামলাকারীদের কোন শাস্তি হবে না বলেই দেশটির খ্রিস্টান নেতৃবৃন্দ মনে করেন।
২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে আল কায়েদা জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলার জের ধরে আফগানিস্থানে মার্কিন সেনা অভিযান শুরু হয় এবং তালিবান ক্ষমতাচ্যুত হয়। এর বিপরীতে পাকিস্তানে বিভিন্ন গির্জা এবং খ্রিস্টার প্রতিষ্ঠানে জঙ্গি হামলা বহু হতাহত হয়েছে।
ব্লাসফেমি আইনটিকে সমালোচনা এবং সংশোধনের পক্ষে কথা বলার জেরে ২০১১ সালে পাকিস্তানের প্রথম খ্রিস্টান ফেডারেল মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টি পাকিস্তানি তালিবানের হাতে গুপ্তহত্যার শিকার হন।
পাকিস্তানি খ্রিস্টানদের অধিকাংশ হতদরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের মানুষ। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দরিদ্র খ্রিস্টান বিভিন্ন শহরে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদেরকে অধিকাংশ মুসলিম হেয় চোখে দেখেন এবং তাদের আদতে কোন সামাজিক মর্যাদার যোগ্য মনে করেন না। বেশ কিছু শহরে সামাজিকভাবে হেয় করতে শুধুমাত্র খ্রিস্টানদেরকে নিয়োগ দেয়ার জন্য পরিচ্ছন্নতা কর্মীর চাকুরির বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না পাকিস্তানের খ্রিস্টান সম্প্রদায় শুধু সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন এবং পশ্চাৎপদই নয় বরং মৌলবাদী গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় শক্তির হাতে চরমভাবে নিগৃহীত। বিশে^র সবচেয়ে নির্যাতিত এবং অবহেলিত খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর তালিকায় পাকিস্তানি খ্রিস্টানরা উপরের দিকে থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ময়দানে খ্রিস্টানরা তাদের নগন্য সংখ্যার কারনে মূল ধারার রাজনৈতিক দল এবং সরকারের কাছে যুগের পর যুগ ধরে গুরুত্বহীন। যদিও খ্রিস্টানদের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে এবং সহায়তা পেয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হওয়ার বহু নজির রয়েছে। অনেকেই খ্রিস্টানদেরকে জীবনে উন্নতির সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে, কিন্তু তাদের অনেকেই খ্রিস্টানদের ক্ষমতায়নে আগ্রহী না।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের যারা রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হন, তারা তাদের দলীয় অবস্থান এবং পদ-পদবি ধরে রাখায় বেশি তৎপর থাকেন। নিজ সম্প্রদায়ের ভালো-মন্দের খোঁজ রাখার দিকে তাদের তেমন একটা নজর দিতে দেখা যায় না।
আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার হলো খ্রিস্টানরা যেমন মোটাদাগে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়াটাকে তেমন গুরত্বপূর্ণ মনে করে না, তেমনি ধর্মীয় বা মান্ডলিক নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে খুব একটা উৎসাহও দেন না, এবং গঠন-প্রশিক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেন না। মান্ডলিক আইনে যাজকদের সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপারে বিধি-নিষেধ রয়েছে। কিন্তু তাদের পক্ষে ভক্তজনগণকে রাজনীতিকে জড়িত হওয়া বা কোন ফোরাম গঠনের মাধ্যমে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে কোন বাধা নেই। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় যে হয়তো বা নিজেদের ক্ষমতা কমে যাবে এ ভয়ে ধর্মীয় নেতারা সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিকাশের প্রতি তেমন দৃষ্টিপাত করতে চান না!
তেতো হলেও সত্য যে খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতা এবং ভক্তজন উভয়ের মধ্যে নিজেদেরকে নিজস্ব সুবিধা-অসুবিধার মধ্যেই গন্ডিবদ্ধ রাখার প্রবণতা রয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু ও জাতীয় সংকটকালে খ্রিস্টানরা সচরাচর নীরব দর্শকের ভূমিকা নেয়। দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হলে, রাজনৈতিক সহিংসতা, অর্থনৈতিক সংকট, কালো আইন কিংবা ধর্ষণ, খুন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মতো অপরাধ বেড়ে যাওয়া নিয়ে খ্রিস্টান নেতা এবং সাধারণ ভক্তদের খুব একটা উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় না। সরাসরি খ্রিস্টানদের উপর কোন আঘাত না এলে ভারত, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে সর্বত্রই খ্রিস্টানরা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এ কারণে সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে খ্রিস্টানরা অপ্রাসংগিক এবং অগুরুত্বপূর্ণ রয়ে যায়।
দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষিত খ্রিস্টানদেরকে তাদের শত বছরের আরামপ্রদ ঘেরাটোপ ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে হবে। উপমহাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং বিস্তারকে রোধ করতে হলে খ্রিস্টানদের আরো বেশি করে রাজনীতি সম্পৃক্ত এবং সচেতন হওয়ার কোন বিকল্প নেই। দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভা খ্রিস্টান নেতৃত্বকে উৎসাহ দেয়া শিক্ষা দেয়।
খ্রিস্টানদেরকে মনে রাখতে হবে খ্রিস্টযাগে যোগদান এবং খ্রিস্টপ্রসাদ গ্রহণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গণতন্ত্র রক্ষা এবং দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করা প্রত্যেক খ্রিস্টানের অবশ্যকর্তব্য। বাইবেল বলে, যদি আমি ঈশ^রের উপাসনা করতে দৌঁড়ে প্রভুর গৃহে যাই এবং পথে আহত ব্যক্তির প্রতি দয়াশীল না হই, তবে আমার সে প্রার্থনার কোন মানে নেই।।
No comments:
Post a Comment