Feb 3, 2025

গল্প: সোনালী ভোর

Credit: gardenersworld.com

ভাগ্য নিয়ন্তার লীলাচক্রে ঠিক এমনি করে অমিতের দেখা পেয়ে যাবে, কোনদিন কল্পনাও করেনি অঞ্জন। বেশ কয়েক বছর আগে তন্নতন্ন করে খুঁজেও যে মানুষটার হদিশ পায়নি, যার জন্যে বারবার ভগবানের কাছে করজোড়ে মিনতি জানিয়েছে, বেঁচে থাকলে যেন অন্ত:ত একটিবার দু'জনের দেখা হয়।

সেই অমিত আজ তার সামনে এক জলজ্যান্ত সত্য হয়ে মূর্তিমান। দশটা বছর, সময়ের মাপকাঠিতে দীর্ঘই বটে। তবুও অমিত চ্যাটার্জীর মতো মানুষকে আগাগোড়া বদলে দেয়ার জন্য তা কি যথেষ্ট? তাইতো মেডিকেলের বেডে শায়িত সংজ্ঞাহীন অমিতের অস্থিচর্মসার দেহের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকেও বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চায় না তার। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু, মেধাবী শিক্ষার্থী ও তুখোড় ছাত্রনেতা অমিতের উচ্ছল-তাগড়া অবয়বের সাথে আজকের অমিতকে কোনভাবেই মেলাতে পারে না সে। বিশ্বেশ্বরের বাসনা বোঝা বড় দায় কথাটা অমিতকে দেখে নতুন করে উপলব্ধি করলো অঞ্জন। মনে পড়ে গেল সকালের ছোট্ট ঘটনাটার কথা। দু'টি ঘটনার মাঝে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করলো সে। ঘুরে ফিরে মনে হতে লাগলো সত্যিই এ এক আশ্চর্য দৈব সংযোগ!

আজ সকালে অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু আগেই অফিসে যাওয়ার তাড়া ছিল। কেননা স্ত্রী অনন্যা বায়না ধরে বলেছিল, “আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরো। অনেকদিন ধরে শপিং-এ যাই না। আজ কিন্তু যেতেই হবে।” কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে গোড়াতেই ছোট্ট একটা ভুল হয়ে গেল। তিনতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে বুঝতে পারল মোটর সাইকেলের চাবিটা সঙ্গে করে আনা হয়নি। পাঁচ বছরের চাকুরী জীবনে আজই প্রথম এমন ভুল হলো তার। দেরী না করে উপরে এসে চাবিটা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল অফিসে। অনন্যাও অবাক চোখে স্বামীকে প্রথমবারের মতো ভুলোমনা হতে দেখে মুচকি হেসে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

যাহোক, দ্রুত অফিসে পৌঁছে জরুরী কিছু নথিপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো অঞ্জন। আপাতত এটাই আজকের প্রধান কাজ। কাজের ভীড়ে সকালবেলা ঘটে যাওয়া তুচ্ছ ভুলটার স্মৃতি মন থেকে উবে যেতে সময় লাগলো না। তিনটে নাগাদ কাজ শেষ হয়ে গেলে বেরিয়ে পড়লো বাসার উদ্দেশ্যে। ধানমন্ডি থেকে সেগুন বাগিচা খুব বেশি দূরের পথ নয়, যদিও ট্রাফিক জ্যামে পড়ে মাঝে মধ্যে তেমনটাই মনে হয়। রাস্তায় আজ তেমন জ্যাম ছিল না। মোটর সাইকেলের স্পীড বাড়িয়ে কিছুটা ফুরফুরে মেজাজে সায়েন্স ল্যাবরেটরী পার হয়ে গেল অঞ্জন। কিছুক্ষণ পরেই ঘটে গেল অপ্রত্যাশিত সেই দুর্ঘটনাটা।

ভোজবাজির মতো কোথা থেকে যেন অর্বাচীন এক পথচারী নাকের ডগা দিয়ে রাস্তা ক্রস করতে দৌঁড় লাগালো। তড়িৎগতিতে ব্রেক কষল অঞ্জন। চাকা স্কিড করার কর্কশ আওয়াজ উঠলো, কিন্তু সংঘর্ষটা এড়ানো গেল না। ধাক্কায় রোগাটে চেহারার লোকটা দুপুরের তপ্ত রাজপথে ছিটকে পড়লো। মোটর সাইকেল স্টপ করে তৎক্ষণাৎ আহত লোকটার পাশে এসে দাঁড়ালো সে আর মুহুর্তেই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল। দশ বছর পরে হলেও তার চিনতে একটুও ভুল হলো না একদার প্রাণপ্রিয় বন্ধু অমিতকে। দ্রুত কর্তব্য স্থির করলো সে। একটা ট্যাক্সি ডেকে অচেতন অমিতকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সী বিভাগে ভর্তি করালো। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে কর্তব্যরত ডাক্তার জানালেন, “আঘাত তেমন মারাত্মক নয়। বেশ কয়েকটা সেলাই দিতে হবে শরীরের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানগুলোতে। আর জ্ঞান হারিয়েছে খুব সম্ভবত না খাওয়া অবস্থায় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে বিধায়। কয়েক সপ্তাহ লাগবে সেরে উঠতে।” স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো অঞ্জন। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে ফিরে পেয়ে আবার হারাতে হলে সে বেদনা আর বাঁধ মানতো না তার।

এতক্ষণে মনে পড়লো অনন্যাকে ফোন করে ব্যাপারটা জানানো দরকার। পকেট থেকে সেলফোনটা বের করতেই আবার অবাক হতে হলো। কী আশ্চর্য, মোবাইলটা এতক্ষণ অফ করা ছিল। তা না হলে অনন্যা নিজেই এতক্ষণে ফোন করতো। কল করা মাত্রই অপরপ্রান্তে স্ত্রীর কন্ঠ শুনতে পেয়ে আশ্বস্ত হলো। অনন্যা বেশ উদ্বেগের স্বরে জানতে চাইলো, “কী ব্যাপার? এত দেরী করছো কেন? আর মোবাইলটা অফ করে রেখেছিলে কেন?” জবাবে অঞ্জন বললো, “আমি এখন ঢাকা মেডিকেলে। না, না আমার কিছু হয়নি। সব কথা ফোনে বলতে পারছি না। তুমি বরং হাসপাতালে চলে এসো। সরি, আজ আর শপিং-এ যাওয়া হলো না।” স্বামীর কথা শুনেও শঙ্কার মেঘ কাটলো না অনন্যার মন থেকে। দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই রওনা হলো হাসপাতালের পথে।

অমিতের শয্যার পাশে বসে বসে একদিকে অনন্যার জন্য অপেক্ষা আর অন্যদিকে বন্ধুর জ্ঞান ফেরার আশা করছিল অঞ্জন। মনের পর্দায় ভীড় করে এলো ফেলে আসা দিনগুলোর অজস্র স্মৃতি। এতটাই সজীব সেগুলো যেন হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলা যায়। 

তখন সবেমাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষার বৈতরণী পেরিয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছে অঞ্জন। কয়েকদিনের মধ্যে অনেক বন্ধু-বান্ধব জুটে গেল। পরিচয় হলো সুর্দশন চেহারার অমিতের সাথে। সেই থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বী দুই মেধাবী সহপাঠীর নিবিড় সখ্যের সূচনা। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান অঞ্জন আর অমিত তার ব্যবসায়ী পিতার একমাত্র ছেলে। উভয়ের আর্থিক অবস্থা ভিন্নতর হলেও তা কোনদিন তাদের গভীর সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারেনি। ছেলে হিসেবে অমিত ছিল এক ওয়ান্ডার বয়। পড়াশুনা ছাড়াও খেলাধূলা, বিতর্ক, গান-বাজনা এমনকি ছাত্র রাজনীতিতেও তার বলিষ্ঠ পদচারণা ছিল। মোট কথা, প্রস্ফুটিত ফুলের মনোরম শোভার মতোই তার তারুণ্য সবাইকে আমোদিত করতো। 

অঞ্জন চিরকালই শান্ত-সুবোধ চরিত্রের। নিভৃত জীবনই তার বেশি পছন্দের। প্রিয় বন্ধুর বহুমাত্রিক প্রতিভাকে সে শ্রদ্ধা করতো, তাকে উৎসাহ জোগাত। বিজ্ঞান বিভাগের অন্যান্য বন্ধুরা অমিত ও অঞ্জনের নিবিড় বন্ধুত্বে মুগ্ধ হয়ে দু'জনের নাম দিয়েছিল “মানিকজোড়”। দুই বন্ধুর অকৃত্রিম সখ্যতার মাঝেও একটা ব্যাপারে দু'জনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। উভয়েই ধর্মভীরু ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে আসা সত্ত্বেও অঞ্জন মুখার্জীর মাঝে ধর্মের ভাব যতটা প্রবল ছিল, অমিত চ্যাটার্জীর বেলায় তা ছিল ততটাই শিথিল। অঞ্জন ধর্মকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করতো আর অমিতের কাছ তা যেন এক ছেলে-ভুলানো ফন্দি। মোট কথা, ঈশ্বর বলে যে কেউ একজন আছেন, সেই পরাক্রমশালী সর্বশক্তিমানের সত্তায় তার কোন বিশ্বাস-ভক্তি ছিলো না। যুক্তিবাদী অমিতকে তার বাবা মা থেকে শুরু করে বন্ধু অঞ্জন পর্যন্ত কট্টর নাস্তিকতার পথ থেকে টলাতে পারেনি। কোন যুক্তিই তার কাছে ধোপে টেকেনি। অথচ এই দোষটুকু বাদ দিলে অমিতকে সর্বাঙ্গসুন্দর মানুষ না বলার কোন কারণই থাকতো না। অঞ্জনের ধর্মভীরুতা নিয়ে অমিত হালকা রসিকতা করতেও ছাড়তো না। তবুও দু'জনের বন্ধুত্ব কলেজ জীবনের পুরোটা সময় জুড়েই সুদৃঢ় ছিল। 

অমিত ও অঞ্জন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচ.এস.সি. পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান লাভ করে উত্তীর্ণ হয়। দুজনে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন বুকে নিয়ে ভর্তি হলো প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা ‌বিশ^বিদ্যালয়ে। অঞ্জন আগের মতোই পড়াশুনা চালিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু, অমিত এখানে এসে আরো বেশি করে জড়িয়ে পড়লো ছাত্র রাজনীতিতে। পার্টি করতে গিয়ে পরিচয় হলো আন্ডারওয়ার্ল্ডের অনেকের সাথে। কুসঙ্গে পড়ে অমিত ধীরে ধীরে নেশা করতে শুরু করে। বন্ধু অঞ্জনের সঙ্গে ইদানীং দেখাই হয় না তার। অঞ্জন প্রিয় বন্ধুর এই পরিবর্তন আঁচ করতে পেরে একটু ফুরসৎ খুঁজতে থাকে কথা বলার। কিন্তু অমিতের দেখা পাওয়াই কঠিন ব্যাপার। অঞ্জন ভাবতেও পারেনি অমিত কতটা অধঃপতিত হয়েছে। বাড়ীতে বা ক্যাম্পাসে চষে বেরিয়েও তার পাত্তা পাওয়া যায় না। নিরুপায় অঞ্জন একপ্রকার বাধ্য হয়ে অমিতের মনের মানুষ অর্পিতার সঙ্গে যোগাযোগ করলো। কিন্তু তার কাছ থেকেও বন্ধুর কোন খোঁজ পেলো না। 

হঠাৎ একদিন ক্যাম্পাসেই অমিতকে পাওয়া গেল। চেহারার কী হাল হয়েছে ওর। মুখের শ্রী লুপ্তপ্রায়। অঞ্জন জিজ্ঞেস করলো, “অমিত কোথায় ছিলি এদ্দিন? চেহারার এ অবস্থা কেন তোর?” অমিত দায়সারাভাবে জবাব দিলো, “ও কিছু না। পার্টিতে কাজের চাপ যাচ্ছে খুব।” অমিতের কথায় মোটেই আশ্বস্ত হতে পারলো অঞ্জন। বললো, “অমিত, আমি তোর বন্ধু হিসেবে বলছি, তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিতে পারে এমন কোন কাজ তুই করিস্ না। মিছিমিছি ঈশ্বরের দেওয়া অমূল্য প্রতিভা যদি বিনষ্ট হয়ে যায়, তার জন্যে কিন্তু একদিন জবাবদিহি করতে হবে।” শুনে অমিত তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে রূঢ় ভাষায় বললো, “হয়েছে, আর ধর্মের বুলি কপচাতে হবে না। তুই সরস্বতীর বাছুর হয়ে বিদ্যার্জন করতে থাক। পড়াশুনা ছাড়াও আমার অনেক কাজ আছে। হাতে সময় নেই, চলি।” 

কথাগুলো তীব্র শেলের মতো অঞ্জনের মর্মমূলে আঘাত করলো। অমিত চলে গেলে পর এক বুক ব্যথা নিয়ে সে বাসায় চলে গেল। আজই বুঝতে পারলো অমিত তার কাছ থেকে বহুদূরে চলে গেছে। প্রায় একমাস এই আঘাতের শোকে অমিতের কোন খোঁজই নিলো না। কিন্তু যার মনে অকৃত্রিম বন্ধুবাৎসল্য, সেকি সামান্য দুর্ব্যবহারে বন্ধুকে ভুলে যেতে পারে? সব ব্যথা ভুলে গিয়ে বন্ধুত্বের টানে অমিতের সঙ্গে দেখা করার প্রবল ইচ্ছা হলো তার। কিন্তু পরিচিত মহলের কেউই বলতে পারলো না অমিত কোথায় আছে। সবচেয়ে বিস্ময়বোধ করলো যখন অমিতদের বাসায় গিয়ে জানা গেলো তাদের কেউই এখানে থাকে না। কষ্ট পেলো অর্পিতার জন্য, বেচারী একদম মুষড়ে পড়েছিল। অমিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে কোথায় যে ডুব মারলো, আর পাত্তা পাওয়া গেল না। 

সময় নিজের গতিপথে নিরন্তর চলে যায়। অমিতের অন্তর্ধানের পর বহুদিন পার হয়ে েেগেছ। ইতিমধ্যে অঞ্জন অর্নাস ও মাস্টার্স শেষ করে একটি বহুজাতিক আইটি কোম্পানীতে ভাল বেতনে চাকরী জুটিয়ে নিয়েছে। অনন্যার সাথে অল্পদিনের পরিচয়ে বিয়ের ছাদনাতলা ঘুরে সম্পর্কটাকে চিরস্থায়ী রূপ দিয়েছে। দু'জনে মিলে পরিকল্পনা মতো আরও কয়েক বছর পর সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংসারে নতুন অতিথি না এলেও সুখের কোন ঘাটতি নেই। 

দাম্পত্য ভালবাসায় সুখের বেলাভূমি গড়েও মাঝে মাঝে অঞ্জন আনমনা হয়ে যেতো। হারানো বন্ধুকে ফিরে পাবার ইচ্ছায় মন কেমন করতো তার। কিন্তু অমিতের কোন আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেও তার পরিচয় ছিল না, যাতে বন্ধু বা তার পরিবারের কোন খোঁজ পেতে পারে। সুচারুভাবে ধর্মীয় পার্বণাদি পালনকালে সংসারে সুখ-সমৃদ্ধি ছাড়াও বন্ধুর মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করতো। স্ত্রীকে নিয়ে মাঝে মাঝে মন্দিরেও একই উদ্দেশ্যে মানত দিতো। অনন্যা স্বামীর ধর্মভীরু আচরণকে তার চরিত্রের অংশ বলেই মনে করতো। আসল কারণ তাই তার অজানাই রয়ে গিয়েছিল। “এতদিনের আর্জি আজ বুঝি মঞ্জুর করলেন ভগবান” ভাবলো অঞ্জন। ভগবানের প্রতি বিশ^াস আরো বদ্ধমূল হলো বন্ধুকে এইভাবে ফিরে পেয়ে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। অনন্যা এসে পৌঁছানোর পূর্বে এভাবেই হারানো দিনের স্মৃতি তর্পণে মশগুল হয়ে পড়েছিল অঞ্জন। সম্বিৎ ফিরে পেলো নার্সের ডাকে। নার্স জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি অঞ্জন মুখার্জী?” অঞ্জন হ্যাঁ বলতেই সে জানালো, একজন মহিলা তার খোঁজ করছে। অঞ্জন বুঝলো, অনন্যা পৌছে গেছে। খানিক পরেই অনন্যা কেবিনে প্রবেশ করলো। স্বামীকে অক্ষত দেখে তার মন থেকে শঙ্কার মেঘটুকু উড়ে গেল। আহত অমিতকে চিনতে না পেরে প্রশ্ন করলো, “উনি কে? আর তুমিই বা এখানে এলে কেন?” অঞ্জন সংক্ষেপে অমিতের পরিচয়, হারিয়ে যাওয়া ও আজকের দুর্ঘটনার কথা জানালো। সব শুনে অনন্যাও অমিতের জন্য সমবেদনা অনুভব করতে লাগলো। তখন পর্যন্ত অমিতের জ্ঞান ফেরেনি। কিছুক্ষণ পর তার দেহে নড়াচড়ার আভাস দেখা গেল। উৎসুক হয়ে স্বামী-স্ত্রী দু'জনে রোগীর বিছানায় এসে বসল। জ্ঞান ফিরে পেতেই অমিত বোঝার চেষ্টা করলো, সে এখন কোথায়। ওষুধের কড়া গন্ধ পেয়ে বুঝলো জায়গাটা হাসপাতাল। ঝাপসা চোখে সামনে বসে থাকা নর-নারী দু'জনকে চেনার চেষ্টা করলো, কিন্তু সফল হতে পারলো না। মাথা ও শরীরের অন্যান্য স্থানে প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হলো। অঞ্জন বন্ধুর হাত ধরে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। ইচ্ছে হচ্ছিলো দু'টো কথা বলার, কিন্তু উপায় নেই ডাক্তারের বারণ আছে। ওষুধ-পথ্য ও একজন স্পেশাল নার্সের ব্যবস্থা করে সেদিনের মত দু'জনে বাসায় ফিরে গেল।

দু'দিন পর কথা বলার মত সুস্থতা ফিরে পেল অমিত। আবেগে রুদ্ধ গলায় প্রথমে কোন কথাই বলতে পারলো না অঞ্জন। পরক্ষণে নিজেকে সামনে নিয়ে শুধালো, “আমাকে চিনতে পারছিস্ অমিত? আমি অঞ্জন, তোর বন্ধু!” অমিত দুর্বল গলায় বললো, “হ্যাঁ রে অঞ্জন, তুই ছাড়া আমার আর আপন বলতে কেউ কি আছে? আচ্ছা আমার কী হয়েছিল বলতো?” অঞ্জন বন্ধুর মুখে নিজেকে চেনার কথা শুনে এত খুশি হলো যে তা বলার মত নয়। সে বললো, “আজ থাক্। পরে তোকে সব জানাবো। নে, এখন বিশ্রাম কর। এ মুহুর্তে এটাই তোর সবচেয়ে বেশি দরকার।” সেদিন আর কোন কথা হলো না। পরবর্তী দু'টো সপ্তাহ খুব দ্রুত কেটে গেল। অঞ্জন ও অনন্যা প্রতিদিন সময় করে অমিতকে দেখতে গেছে। আন্তরিক সেবা ও পরিচর্যার গুণে দ্রুত সেরে উঠল অমিত। এরই মাঝে অমিত বুঝে গেল অনন্যা অঞ্জনের ঘরণী। দু'জনের সাথেই তার সম্পর্ক সহজ হয়ে এলো। হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাবার পর স্বামী-স্ত্রী দু'জনে তাকে নিয়ে এলো তাদের নিজস্ব ফ্ল্যাটে।

সপ্তাহখানেক পর একদিন রাতের আহার সেরে তিনজনে বসেছিল ফ্ল্যাটের ছাদে গল্প-গুজব করতে। চন্দ্রালোকিত আকাশের নীচে বসে অঞ্জন অমিতকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলো তার বিগত জীবনের কথা বলার জন্য। স্বামী-স্ত্রীর কেউই ভাবতে পারেনি কী করুণ জীবনের উপাখ্যান শোনাবে অমিত। সে বললো, “জানিস্ অঞ্জন, আজ আমার নিজের উপর প্রচন্ড ক্ষোভ হচ্ছে এই ভেবে যে, আমারই ভুলে জীবনের দশটা সোনালী বছর নষ্ট হয়ে গেছে।” অঞ্জন প্রশ্ন করলো, "ক্যাম্পাসে তোর সাথে দেখা হবার ঠিক একমাস পর তোদের বাসায় গিয়ে কাউকে পাইনি। তোরা সব কোথায় গিয়েছিলি? আর তোর এ হালই বা হলো কেমন করে?"

জবাবে অমিত সব খুলে বলতে লাগল। যেদিন দু'বন্ধুর শেষ দেখা হয় তার এক সপ্তাহের মাথায় অমিতের বাবা হার্ট এ্যাটাকে মারা যান। ব্যবসায় ভরাডুবি হওয়ার কথা কাউকে জানাতে পারেননি অসিতবাবু। এমনকি দেনার দায়ে বাড়ীখানাও যে বন্ধক রাখতে হয়েছে তাও জানাতে পারলেন না কাউকে। ব্যাংকে যা সঞ্চয় ছিল শেষকৃত্যে ও শ্রাদ্ধে সব নি:শেষ হয়ে গেল। দিশেহারা অমিত কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। স্বামীর মৃত্যুতে অমিতের মা অত্যন্ত মুষড়ে পড়েছিলেন। যেদিন জানা গেল বাড়ীটাও বন্ধক রাখা সেদিন থেকেই শয্যা নিলেন তিনি। মাত্র তিনদিনের মাথায় বুকের প্রচন্ড ব্যথার অবসান ঘটিয়ে যাত্রা করলেন পরপারে। অর্থাভাবে মার শেষকৃত্যও ভালভাবে করতে পারে নি অমিত। আত্মীয়-স্বজনরা এহেন দুর্যোগে মুখে মুখেই সান্ত্বনার বাক্য শোনালেন, কেউ এসে এতিম অমিতের পাশে দাঁড়ালেন না। বাবা-মার মৃত্যুশোক কেটে যেতেই নিজেকে স্বাধীন মনে হলো তার। ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি, তার জীবনের দুঃস্বপ্নের রাত এখনো কাটেনি। পিতার মৃত্যুতেই যার সূচনা হয়েছে। বন্ধকী বাড়ীটা ছেড়ে দিতে হলো। মেধাবী অমিত পার্টি করে করে অনার্স ফাইনালও দিতে পারেনি। যে পার্টির জন্যে এতকিছু করেছে সে, সেই পার্টিই একদিন তাকে ছুঁড়ে ফেললো। দলীয় এক নেতার সাথে দ্বন্দ্বের জের ধরে সুকৌশলে তাকে পার্টি থেকে বের করে দেওয়া হল। ভাল কোন চাকরিও জোটেনি তার। দুয়েকটা যা-ও জুটলো তাতেও পোষাতো না। কারণ মদ, সিগারেট আর গাঁজার পেছনেই চলে যেতো সব অর্থ। বাধ্য হয়ে চোরাচালান করার পথে নামল সে। কিন্তু একবার ধরা পড়ায় সিন্ডিকেট অমিতকে বাদ দিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত মানুষের পকেট মারাই হয়ে উঠে তার জীবিকা। 

এ পর্যন্ত বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অমিত। অঞ্জন-অনন্যা তন্ময় হয়ে ভাগ্যের হাতে নাকাল হওয়া মানুষটার কথা শুনছিল। অঞ্জন এই ফাঁকে জিজ্ঞেস করে বসলো, “মেসো-মাসীমা চলে গেলেন আর তুই আমাকে খবর পর্যন্ত দিতে পারলি না? তাছাড়া অর্পিতাকে কী করে ভুলে গেলি, বল দেখি?” অমিত ধরা গলায় বললো, “তোর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের পর কোন মুখ নিয়ে আবার তোর সামনে দাঁড়াব ভেবে পাইনি আমি। আমার মনটার অবস্থা ছিল মাঝ দরিয়ায় দিক হারানো নৌকার মতো। আমার প্রতি অর্পিতার অনুরাগ নিঁখাদ জেনেও নিজের অপরাধবোধ ওর সামনে ভালবাসার দাবি নিয়ে আমাকে দাঁড়াতে দেয়নি। প্রতি পদে পদে ভুল করে আজ আমি যে অন্ধকারের অতল তলে পতিত হয়েছি তা থেকে উত্তরণের কোন পথই আমার জানা নেই। চারদিকে শুধু নিঃসীম অন্ধকার।” 

অবদমিত আবেগ বাঁধন হারিয়ে চোখের জল হয়ে ঝরতে লাগল অমিতের। অনন্যা প্রবোধ দিয়ে বললো, “এতটা মুষড়ে পড়বেন না দাদা। আমরা তো আপনার পাশেই আছি। সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। আবার নতুন করে জীবন শুরু করবেন, বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন।" অঞ্জনও উৎসাহী কণ্ঠে বলতে লাগলো, “নিয়তির লিখনে বারংবার আঘাত পেয়ে আজ তোর বোধোদয় হয়েছে, এটাই তো সবচেয়ে বড় পাওয়া। সমগ্র বিশ্বেই ভগবানের হাত বিস্তৃত আজ নিশ্চয়ই তুই একথা অস্বীকার করবি না। তোর সব দায়িত্ব আমার। আমি তোর চাকরীর ব্যবস্থা করে দেব। তুই প্রাইভেটে অনার্স-মাস্টার্স কমপ্লিট করে ফেলবি। আর হ্যাঁ, তোকে তো বলাই হয়নি, অর্পিতা আজো বিয়ে করেনি। চিন্তা করতে পারিস তোকে কতটা ভালবাসে মেয়েটা! কালকেই চল দেখা করিয়ে দিই!” 

অমিত বন্ধুপত্মীর সান্ত্বনা আর বন্ধুর আশ্বাসে একেবারে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। অঞ্জনের হাত জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো, “অঞ্জন তুই শুধু আমার বন্ধুই নোস, তুই ঈশ্বরের দূত আমার জীবনে। তোর ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না।” চাঁদাজাগা রাতে জোৎস্না যেন গলে গলে পড়ছে সারা পৃথিবীময়। সেই আলোর পানে চেয়ে চেয়ে অমিত প্রতীক্ষা করতে লাগলো তার জীবনের সোনালী ভোরের অভ্যুদয়ের।।

লেখক: রক রোনাল্ড রোজারিও

রচনাকাল: জুন ২০০৩


No comments:

Post a Comment

গল্প: সোনালী ভোর

Credit: gardenersworld.com ভাগ্য নিয়ন্তার লীলাচক্রে ঠিক এমনি করে অমিতের দেখা পেয়ে যাবে, কোনদিন কল্পনাও করেনি অঞ্জন। বেশ কয়েক বছর আগে তন্নতন্...