ইনানী বিচ, কক্সবাজার, বাংলাদেশ (ছবিঃ এএফপি) |
২০২০ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়। সারা বিশ্ব তখন করোনা মহামারীর প্রবল প্রতাপে বিপর্যন্ত। ইতালীয় একজন প্রাণীবিদ একটি মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করেন যেখানে একটি জেলিফিশকে ভেনিস শহরের হ্রদের নির্মল জলে বিশাল অট্টালিকার প্রতিবিম্বের সাথে খেলা করতে দেখা যায়। করোনা মহামারীর কারণে শূন্য হয়ে পড়ার পূর্বে ভেনিস ছিল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সে বছরের মার্চ মাসের ৯ তারিখে কঠোর লকডাউন শুরু হলে ভেনিস শহর পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে। জেলিফিশের ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং অনেকে বলতে শুরু করে, “প্রকৃতি আবার ভেনিস শহরকে ফেরৎ নিয়ে নিচ্ছে।”
ভেনিস তার অসামান্য পরিবেশগত সৌন্দর্য, নান্দনিক স্থাপত্যশৈলী এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে একাধারে ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্য এবং ইউরোপের অন্যতম রোমান্টিক নগরী হিসেবে নন্দিত। কিন্তু ভেনিসের ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য তার বোঝাস্বরুপ, কারণ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩০ লক্ষ পর্যটক এ নগরীতে ঘুরতে আসেন।
সচরাচর দ্রুতগামী ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও প্রমোদতরীর অন্তহীন চলাচলে ভেনিসের খাল ও হ্রদের জল বিরতিহীনভাবে আন্দোলিত হতে থাকে। তাতে ভেনিস যেন অসহায়ভাবে হাঁপিয়ে ওঠে। পর্যটনের এ দূষণ ছাড়াও নিকটবর্তী পোর্তো মার্ঘেরা শিল্প এলাকা থেকে রাসায়নিক বর্জ্য নি:সরণ ভেনিসের পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরুপ। আর তাই করোনাকালে জনজীবনে স্থবিরতা ভেনিসের পরিবেশের জন্য শাপে বর হিসেবে আবির্ভূত হয়।
হাজারো মাইল দূরে বাংলাদেশের সাগরদুহিতা পর্যটন নগরী কক্সবাজারে করোনা মহামারীকালে এক প্রাকৃতিক পুনর্জাগর লক্ষ্য করা গেছে। এর সূচনা হয় ২০২০ সালের ২৬ মার্চে দেশব্যাপী লকডাউনের পর।
এপ্রিল মাসে বহু বছর পর বঙ্গোপসাগরে ডলফিনকে খেলা করতে দেখা গেছে। সাগরতটের প্রতিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সাগরলতা (Beach Morning Glory) আবার নতুন করে জেগে উঠতে শুরু করে। এ লতাগুল্মটি রেলরোড ভাইন নামেও পরিচিত। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের অন্তহীন চলাচল, নির্বিচার দূষণ এবং অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণের কারণে এ গুরুত্বপূর্ণ গুল্মটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে পরিবেশবিদগণ মনে করতেন।
যদিও কক্সবাজার ভেনিসের মতো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র নয়, তবুও জনবহুল বাংলাদেশের এ নগরীতে প্রতি বছর সবচেয়ে বেশি পর্যটক বেড়াতে আসে। কিন্তু দু:খজনক হলো এ বিপুলসংখ্যক পর্যটকের সিংহভাগ পৃথিবীর এ দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের পরিবেশ নিয়ে মোটেও মাথা ঘামান না এবং যত্রতত্র ময়লা ও আবর্জনা ফেলে পরিবেশকে নোংরা করেন।
যদিও করোনা মহামারী গোটা বিশ্বের জন্য এক মহাবিপর্যয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, কিন্তু ভেনিস ও কক্সবাজারে প্রকৃতির নবজাগরণ ছিল এ মহাসংকটের কতিপয় ইতিবাচক দিকের মধ্যে অন্যতম।
করোনা মহামারী ও পরিবেশ বিপর্যয়
যে ভয়াবহ সংকট আমরা দু:স্বপ্নেও ভাবি নি তার জন্য আসলে কাকে দায়ী করা উচিত?
অনেকে চীনের দিকে আঙ্গুল তাক করেছেন কারণ এ ভাইরাসের প্রাথমিক উৎপত্তিস্থল দেশটির হেবেই প্রদেশের উহান নগরীর একটি বন্য প্রাণী কেনাবেচার মার্কেট, যা পরবর্তীতে চীনের অন্যান্য প্রদেশ ও গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
সত্যি সত্যি কীভাবে এ বৈশ্বিক মহাদুর্যোগের সূচনা হলো তা হয়তো কোন একদিন জানা যাবে, অথবা হয়তো এটি বারমুডা ট্রায়াংগলের অমীমাংসিত রহস্যের মতো চিরকাল অজানাই রয়ে যাবে।
যদি আমরা উহানের বন্যপ্রানীর মার্কেটকেও এর জন্য দায়ী করি, কিন্তু গোটা বিশ্বও কিন্তু এর দায় এড়াতে পারে না। যুগ যুগ ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় খাদ্য ও ওষুধের নামে চীনসহ বিশ্বের নানা দেশে বন্য প্রাণী ও পাখির নির্বিচার হত্যাকান্ড বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বহু বছর ধরে মানব সমাজের সর্বনাশা আক্রমণ শুধুমাত্র বন্য প্রাণী উপরে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরঞ্চ তা প্রকৃতির প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বিস্তৃত হয়েছে। এর খেসারত প্রতিনিয়তই আমাদের দিতে হচ্ছে। প্রতি বছর বিশ্ব জুড়ে বায়ু, ভূমি এবং পানির চরমমাত্রার দূষণ ৯০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ, যা বার্ষিক মোট মৃত্যুহারের প্রায় ১৬ শতাংশ।
এহেন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েও আমরা নিজেদেরকে বদলাই নি বরং আমরা পরিবেশ সংরক্ষণকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে এক সর্বগ্রাসী বস্তুবাদী সংস্কৃতি এবং হৃদয়হীন অর্থনৈতিক উন্নয়নের নেশায় বুঁদ হয়ে আছি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন করোনা মহামারীর সাথে বৈশ্বিক পরিবেশ দূষণের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। তাদের এ ভাবনার সাথে দ্বিমত পোষণ করার কোন কারণ নেই। যুগ যুগ ধরে আমরা বনভূমি ধ্বংস করেছি এবং অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী কেনা-বেচার ব্যবসা করে মানব সমাজকে বন্যপ্রাণীদের সংস্পর্শে নিয়ে এসেছি। এর অনিবার্য পরিণতি হলো আজকের এ ভয়াবহ বিপর্যয়।
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে মানুষ এখনো ভাবতেই শেখেনি যে উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ পাশাপাশি, হাত ধরাধরি করে চলতে পারে। ফলশ্রুতিতে উন্নয়নের নামে নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস, নদ-নদী দখল এবং জীব-বৈচিত্র্য উজাড় নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা।
এ কারণে দেশে ও বিদেশে জোরালো প্রতিবাদের তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের সর্ববৃহৎ উপকূলীয় বন এবং ইউনেস্কো স্বীকৃত প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের কাছাকাছি দুইটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে। এ হঠকারী সিদ্ধান্ত সুন্দরবনের পরিবেশ এবং জীব-বৈচিত্র্যেকে মারাত্নক হুমকিতে ফেলবে সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করেছেন, কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করে নি।
আদৌ কি আমরা পরিবেশকে রক্ষা করতে চাই?
২০১৫ খ্রিস্টাব্দে পোপ ফ্রান্সিস তার পরিবেশ বিষয়ক আলোড়নসৃষ্টিকারী পালকীয় পত্র “লাউদাতো সি” প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি পরিবেশ দূষণকে “পাপ” হিসেবে বর্ণনা করেন এবং পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে এমন উন্নয়নকে “দায়িত্বজ্ঞানহীন উন্নয়ন” হিসেবে ব্যাপক সমালোচনা করেন।
এ পালকীয় পত্রে পোপ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন এমন যা কিছু যা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই: “আমরা যখন পরিবেশের কথা বলি তখন মনে রাখতে হবে, পরিবেশ হলো প্রকৃতি ও মানব সমাজের মধ্যে বিদ্যমান এক সম্পর্ক। আমরা যেখানেই বাস করি না কেন আমরা কখনোই ভাববো না প্রকৃতি আমাদের সত্ত্বা থেকে ভিন্ন কোন কিছু।” (লাউদাতো সি, ৪র্থ অধ্যায়, সমন্বিত প্রতিবেশ)
পরিতাপের বিষয় হলো আমরা প্রায়ই ভুলে যাই আমরাও প্রকৃতির অংশ এবং প্রকৃতির ক্ষতি করা মানে নিজেদেরকে ধ্বংস করা এবং প্রকৃতির সাথে আমাদের সম্পর্ককে নষ্ট করা।
করোনা মহামারীর পূর্বে পোপ ফ্রান্সিস আমাজন অঞ্চলের বিশপদের সাথে সিনডীয় সমাবেশ চলাকালে “পরিবেশগত পাপ” নিয়ে আলোচনা করেন। ক্যাথলিক চার্চের ধর্মশিক্ষা নীতির সংশোধন করে তাতে “পরিবেশগত পাপ” এবং এর সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়েও তিনি প্রাথমিক ইঙ্গিত দেন।
প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষা এবং তথাকথিত “ফেলে দেওয়ার সংস্কৃতিকে” পরিহার করার জন্য পোপের জোরালো এবং মানবিক আবেদন গোটা বিশ্ব জুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো বিশ্ব তার এ আহ্বান কতটুকু কান পেতে শুনেছে ও কাজে লাগিয়েছে।
জাতিসংঘ জলবায়ু সংক্রান্ত একের পর এক বৈশ্বিক মহাসম্মেলনের আয়োজন করেছে, কিন্তু তার পরেও ধরিত্রীকে দূষণ এবং ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হয় নি, এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দুই দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনকে জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করতে পারে নি।
সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধিতে অসামান্য কাজ করেছেন যা গোটা বিশ্ব জুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু তিনি আমাদেরকে এ “গ্রহের মহাসংকট” সম্পর্কে যেভাবে সতর্ক করেছেন এবং উদ্যোগী হতে বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সে অনুসারে তেমন কিছুই করতে সক্ষম হয় নি।
সুইডেনের প্রখ্যাত পরিবেশবাদী কর্মী গ্রেটা থানবার্গের পরিবেশ রক্ষার আবেদন কোটি মানুষকে স্পর্শ করেছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন করেছে। কিন্তু তার এ অসামান্য আন্দোলন কতটুকু ফলপ্রসু হবে তা সময়ই বলে দেবে।
কোন অসাধারণ বই, ডকুমেন্টারি, বক্তব্য বা সম্মেলন -- কোন কিছুই পরিবেশকে রক্ষা করার কাজে আসবে না যদি না আমরা হৃদয়ের রুপান্তর করি এবং নিজেদেরকে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ভাবতে শিখি।
একদিন করোনা মহামারী শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা কি রুপান্তরিত মানুষ হয়ে, প্রকৃতি ও জীব-বৈচিত্র্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসা নিয়ে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবো? যদি তা না হয়, তাহলে ভেনিসের জেলিফিশের মৃত্যু ঘটবে এবং কক্সবাজারের সাগরলতা আবারো বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
মহামারী এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে জরাগ্রস্থ ও নিকৃষ্ট পৃথিবী আমরা রেখে যাবো, তার জন্য ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের কখনো ক্ষমা করবে না।
*****
লেখক: রক রোনাল্ড রোজারিও ঢাকাভিত্তিক সাংবাদিক, লেখক এবং আন্তর্জাতিক ক্যাথলিক সংবাদ মাধ্যম ইউনিয়ন অব ক্যাথলিক এশিয়ান নিউজের (UCAN) উপ-সম্পাদক। ইউকান ওয়েবসাইটে মূল প্রবন্ধটি ইংরেজিতে ২০২০ সালের ১৫ই মে প্রথম প্রকাশিত হয়। সর্বসত্ত্ব লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত।
মূল লেখার লিংক: The pandemic and our ecological sins
No comments:
Post a Comment