বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ১৫ ডিসেম্বর প্রদীপ প্রজ্জলন (ছবিঃ এএফপি) |
সারা বিশ্বের ন্যায় করোনা মহামারীতে বাংলাদেশের জনজীবন বিপর্যস্ত হলেও ২০২১ সালটি ছিল জাতির জন্য একটি উৎসবমুখর ও তাৎপর্য্যপূর্ণ বছর। সে বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে দেশজুড়ে পালিত ‘মুজিব বর্ষ’-র সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচী ও অনুষ্ঠানমালার বর্ণাঢ্য সমাপণী অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের জেষ্ঠ্যা কন্যা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই বছরের শেষদিকে ডিসেম্বর মাসে জাতি পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছে।
শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে গোটা বছর জুড়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে সকল কর্মসূচী পালন করা হয়েছে তার চূড়ান্ত পর্যায়ের অনুষ্ঠানমালা মঞ্চস্থ হয়েছে ১৭-২৬ মার্চ। দেশের গণমান্য ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, নেপাল ও ভুটানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রধান ও প্রতিনিধিগণ একগুচ্ছ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে শামিল হয়েছেন।
মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে এরূপ উচ্চমার্গীয় শ্রদ্ধা ও সম্মান পাওয়ার শ্রেষ্ঠ দাবিদার। কারণ তার সুযোগ্য ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের গুণেই বাঙালি জাতির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তব রূপ লাভ করেছে। আক্ষরিক অর্থেই মুজিব ছিলেন এক মহান ও দূরদর্শী নেতা, যিনি তার গোটা জীবন জনগণের সুখ ও দু:খে পাশে থেকে অতিবাহিত করেছেন এবং জনগণের অধিকার আদায়ের জন্যে বারংবার অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। এ কারণে তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের অধিকাংশ সময়ই জেলখানায় কাটাতে হয়েছে।
স্বাধীনতার পর চরমভাবে যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে তাকে সর্বগ্রাসী দারিদ্র ও ক্ষুধাসহ এবং অসংখ্য সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু জনগণ ও দেশের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল সর্বদা অতুলনীয় ও অতলস্পর্শী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রে সপরিবারে তার বর্বরোচিত হত্যাকান্ড বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কালো এবং মর্মান্তিক অধ্যায়।
যেভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন জাতিকে উজ্জীবিত করেছে, তেমনিভাবে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতেও দেশের জনগণ ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত এক সপ্তাহব্যাপী উদ্বেলিত ছিল।
৫০ বছর আগের এই দিনে দেশ ও বিদেশে কোটি কোটি বাঙালি আনন্দ ও স্বস্তির অশ্রুজল বিসর্জন করেছিল। কেননা সেদিন বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর নিকট হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নি:শর্ত আত্মসমর্পণের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর নব্য-ঔপনিবেশিক এবং পীড়ণমূলক শাসনের ইতি টেনে দেয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে ১৯৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে কুখ্যাত রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক ভুলগুলোর মধ্যে অন্যতম। মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের জন্ম ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অসারতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে। আর তাই স্বাধীনতার জন্য লাখো শহীদের রক্ত ঢেলে দিতে জাতি কুণ্ঠাবোধ করে নি। কিন্তু স্বপ্ন শুধু স্বাধীনতা অর্জনে সীমাবদ্ধ ছিল না। এ জাতি মনে-প্রাণে চেয়েছে স্বাধীনতার পথ ধরে ক্রমে ক্রমে মৌলিক অধিকারসমূহ, যেমন সাম্য, ন্যায্যতা ও মানবাধিকার, যা থেকে তারা যুগের পর যুগ বঞ্চিত ছিল, তা অর্জিত হবে।
সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন আবর্তিত হয়েছে মানুষের প্রতি তার অসীম ভালোবাসা, যার ভিত্তি ছিল জনগণের জন্য সাম্য, মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাকে কেন্দ্র করে । এ কারণে জনগণও তাকে গভীরভাবে ভালবেসেছে। তারা তার দেখানো দারিদ্র্য, ক্ষুধা, দুর্নীতি এবং অন্যায্যতাবিহীন সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছে যা একমাত্র অর্জন করা সম্ভব সততা, নিষ্ঠা এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে। স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুর সরকার জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্র - এই চার মূলনীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের প্রধম সংবিধান প্রণয়ন করে এবং জনগণ তা সাদরে গ্রহণ করে।
মুজিবের মর্মান্তিক পরিণতি বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে পরবর্তী দুই দশকের জন্য থমকে দেয়। একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ প্রায় ১৫ বছর ধরে সামরিক শাসনের রাহুগ্রাসে পতিত হয়। সামরিক শাসকগণ তাদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে সংশোধন করে রাষ্ট্রের মধ্যে ইসলামী ভাবধারা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম চাপিয়ে দেন এবং স্বাধীনতার পরে নিষিদ্ধ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পুনরায় চালুর অনুমোদন দেন। ১৯৯০-র গণঅভ্যুত্থানের ফলে সামরিক শাসনের অবসান এবং গণতন্ত্র পুর্নপ্রতিষ্ঠা হলেও ভোটের রাজনীতির স্বার্থে পরবর্তী কোন নির্বাচিত সরকারই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাতিল করে নি।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখনো তার শিশুকাল অতিক্রম করতে পারে নি। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশ বিগত পাঁচ দশকে আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন সূচকে ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছে।
বাংলাদেশ নবজাতক শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যু হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। হস ১৯৭০-এর দশকে এদেশে প্রতি ১,০০০ নবজাতক শিশুর মধ্যে ১৪৮.৭ জন মৃত্যুবরণ করত, যা বর্তমানে ২৫ জনে নেমে এসেছে। এ সময়ের মধ্যে মাতৃমৃত্যুও হার প্রতি ১০০,০০০ জনে ২৪৫ জন থেকে ১৭৩ জনে কমে এসেছে।
বাংলাদেশ এখনো অধিক জনসংখ্যার দেশ। কিন্তু নারীপ্রতি গড় সন্তান জন্মদানের হার ১৯৭০-এ ছিল ৬-য়ের বেশি, যা বর্তমানে প্রায় ২।
জনগণের গড় আয়ুষ্কাল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২.৮ বছর যা ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও বেশি। ১৯৭০-এর দশকে দারিদ্র্যতার হার ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ, বর্তমানে যা ২৫ শতাংশের মত।
যদিও বাংলাদেশে নারীরা আজো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে তাদের সমান মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই করে যাচ্ছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তারা পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হারে এবং পাবলিক পরীক্ষাতে প্রায়ই মেয়েরা ছেলেদেরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ, বিশেষ করে পোশাক শিল্পে, এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
১৯৭০-র দশকে যে বাংলাদেশকে “তলাবিহীন ঝুড়ি” হিসেবে তাচ্ছিল্য করা হত, সে দেশকে আজ উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে গণ্য করা হয়। এ অসামান্য অর্জনের নিয়ামক বাংলাদেশের বার্ষিক ৩০ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প, প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো বার্ষিক ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এবং দেশের প্রধান উৎপাদনমুখী কৃষি খাত। বাংলাদেশ খুব শীঘ্রই জাতিসংঘের স্বল্পোন্বত দেশের কাতার থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে।
এত সব সুখবর এবং উন্নয়ন বৃত্তান্ত কিন্তু মোটেই বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্র নয়। কার্যকর গণতন্ত্র, আইনের শাসনের অভাব এবং ক্ষমতাসীনদের ক্রমাগত কর্তৃত্ববাদী আচরণের ফলে বাংলাদেশ বারংবার মানবাধিকার এবং মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মুখ থুবড়ে পড়ছে।
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতাসীন রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক বিরোধী শক্তিকে এক প্রকার ধ্বংস করে দিয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সর্বশেষ দুটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল নিরংকুশ জয় নিশ্চিত করতে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীরা এ সময়ে ব্যাপক নির্যাতন, জেল এবং হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন।
নানা প্রকার অগণতান্ত্রিক উপায়ে বিচার বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশনসহ সকল গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে সরকারের আজ্ঞাবহ হতে বাধ্য করা হয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো দমন-পীড়ণমূলক আইন প্রণয়ন এবং অপপ্রয়োগের মাধ্যমে বিরোধী মত এবং সমালোচনার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে, গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি মধ্য দিয়ে জনগণের মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। গত বছর ভিত্তিহীন অভিযোগে লেখক মুশতাক আহমেদকে আটক এবং পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে তার মৃত্যু এসব কালো আইনের অপব্যবহারের নিকৃষ্টতম উদাহরণ।
দেশের আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও গুমের অভিযোগ রয়েছে, কিন্তু তাদেরকে ঢালাওভাবে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদ এবং উদারপন্থী, ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুসহ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের উপর জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটেছে। কেউ কেউ মৌলবাদের উত্থানের পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থে সরকারের বিভিন্ন ইসলামী গোষ্ঠীকে তোষণের নীতিকে দায়ী করে থাকেন।
২০১৩ সাল থেকে ইসলামী জঙ্গীদের হামলায় নাস্তিক ব্লগারদেও হত্যাকান্ড শুরু হলে সরকার ব্লগারদের পাশে না দাঁড়িয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখার কোন উদ্যোগ নেয় নি। উল্টো বরং ব্লগারদেরকে “সীমা লংঘন” না করতে সতর্ক করে দেয়া হয়। সরকারের এ হঠকারীতা ব্লগার ও লেখকদেরকে চরম হতাশ করে এবং জীবন বাঁচাতে অনেকে দেশ ত্যাগ করে ইউরোপ এবং আমেরিকায় আশ্রয় নেয়।
লাগামহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার তেমন কোন পদক্ষেপ নেয় নি। এর ফলশ্রুতিতে করোনা অতিমারী মোকাবেলায় সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে ব্যাপক অনিয়ম এবং চরম অব্যবস্থাপনা ধরা পড়ে।
এখনো দেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষ দরিদ্র হলেও আগামী কয়েক বছরে বাংলাদেশ সবচেয়ে দ্রুত ধনশালী ব্যক্তিবর্গের শতকরা হারে বিশ্বে তৃতীয় স্থান অর্জন করবে। ইতিমধ্যে বৈশ্বিক অসাম্যতার সূচকে বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষস্থানে রয়েছে।
আসল কথা হল অত্যন্ত ধনবান এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সকল সুফলকে এককভাবে ভোগ করছে। অন্যদিকে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ চরম অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
সামাজিকভাবে বাংলাদেশে যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যাসহ নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে। এর কারণে দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশ ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে।
সবচেয়ে দু:খজনক ব্যাপার হলো প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সিভিল সোসাইটি এবং সচেতন নাগরিক সমাজ দেশের এহন দুরাবস্থা সত্ত্বেও অনেকাংশে নীরব। এর পেছনে সরকারের দমন-পীড়ন যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী তাদের অর্জিত সম্পদ ও সম্মান খোয়ানোর ভয়।
যদিও বাংলাদেশের সব লোক মুজিব কন্যার নেতৃত্বাধীন দলকে সমর্থন করে না, কিন্তু তার জীবন ও কর্ম দেশের সিংহভাগ মানুষের কাছে আদর্শ ও অনুপ্রেরণা। পরিতাপের বিষয় হলো তার সেই দলের হাতেই জাতির মৌলিক ভিত্তি স্বাধীনতা, অধিকার, মানব মর্যাদা ও মানবাধিকার যা তাড়ণায় জাতি মুজিবের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, সেসব ক্রমশই হুমকির সম্মুখীন।
বিগত দশকের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চিত্রে জাতির আনন্দিত ও গর্বিত হওয়ার যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার, ন্যায্যতা ও গণতন্ত্রের করুণ দশা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করেছে।
বাংলাদেশের মানুষের কাছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এক পবিত্র লড়াই এবং আবেগমথিত ইতিহাস যা জনমানসে চিরকালের মত গেঁথে রয়েছে। এ যুদ্ধ বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রকে আজো ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে এবং ভবিষ্যতেও করবে। পাকিস্তান আমলের ইসলামী প্রজাতন্ত্রের দু:শাসনের অভিজ্ঞতা আছে বলে এদেশে ইসলামী দলগুলো জনসমর্থনের অভাবে কখনোই বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি।
দু:খজনক হলেও সত্যি যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, সে দলটিই মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় স্বার্থে ছিনতাই্ করে কুক্ষিগত করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে দলটি তার প্রধান রাজনৈতিক সম্পত্তি হিসেব গণ্য করে এবং নিজ দলের বাইরে নানা ব্যক্তি ও দলের মুক্তিযুদ্ধে অবদানকে স্বীকার করতেই চায় না। কেউ যদি দলটির যৌক্তিক সমালোচনাও করে তবে তাকে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহকের” প্রতি অসম্মান হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে শাস্তির খড়গ নেমে আসে।
যে দল গণতন্ত্র এবং আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা করে নি, সে দলের বিরুদ্ধে আজ দমনমূলক আইন ও নীতির বদৌলতে দেশে একদলীয় শাসন কায়েম, গণতন্ত্রের নীরব মৃত্যু এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার অভিযোগ।
২০১৪ এবং ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচন সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ পার পেয়ে গেছে ভারতের সমর্থনে। ১৯৯০-ও দশকে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং আওয়ামী লীগ পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে এবং এর ফলে শিশু গণতন্তের দেশে অনেকটা চেক-এন্ড-ব্যালেন্স (ভারসাম্য) বজায় ছিল। তা এখন সুদূর অতীতের বিষয়। দেশে বিরোধী শক্তিকে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে, আর সরকারী দল খেয়াল-খুশিমত যা কিছু করার তা করে চলেছে। চরম মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমুল্যের লাগামহীনতায় জনগণের নাভিশ্বাস উঠে গেছে, কিন্ত এ অরাজকতার প্রতিবাদ করার মতো কেউ নেই।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারের অবদান কম হলেও এর পুরো কৃতিত্ব সরকার নিজের পকেটে পুরতে চায়। কিন্তু দলটি গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও অধিকারের মৌলিক ভিত্তিকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর দায় কখনো স্বীকার করবে না।
বিগত এক দশকে শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, গুম এবং অন্যান্য মানবাধিকার লংঘনের দায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুলিশের বিশেষ বাহিনী র্যাব এবং এর বর্তমান ও সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এর মাধ্যমে মার্কিন সরকার বাংলাদেশকে গণতন্ত্রবিহীন চীন, রাশিয়া এবং মায়ানমারের কাতারে শামিল করেছে। এর পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডিসেম্বর ৯-১০, ২০২১ তারিখে অনুষ্ঠিত গণতন্ত্র শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণও বাংলাদেশ পায় নি।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরেই এমন ভাবমূর্তির সংকটে বাংলাদেশকে পড়তে হল! প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরনার্থীদের উদারভাবে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী যে সুনাম ও সম্মান অর্জন করেছিল তা এক প্রকার ধুলায় লুটাবার উপক্রম হয়েছে।
রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পাঁচ দশক পেরিয়ে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক সূচকে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে তা নিশ্চয়ই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু উন্নয়নের সুফল বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ভোগ করতে সুযোগ দিতে হলে তাদের সাংবিধানিক এবং মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করতে হবে, যা রাজনৈতিক সদিচ্ছা ব্যতীত সম্ভব নয়। গণতন্ত্র, ন্যায্যতা ও মানবাধিকার ব্যতীত উন্নয়ন প্রকৃত উন্নয়ন নয়। দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের হালচাল দেখে মনে হয় ক্ষমতাসীন দল গণতন্ত্র ও অধিকারের পরিবর্তে উন্নয়নের দিবাস্বপ্নে জনগণকে বুঁদ রাখতে চায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আজীবন জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তার দেখানো সোনার বাংলার স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং অবিচার বিহীন একটি রাষ্ট্রের রূপরেখা। আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে মনে হয় সে স্বপ্নকে বাস্তব দেখতে, সত্যিকার স্বাধীনতার স্বাদ পেতে আপামর জনতাকে আরো বহুদিন সংগ্রাম করতে হবে।
---------------০--------------
রক রোনাল্ড রোজারিও: লেখক ও সাংবাদিক। বর্তমানে হংকংভিত্তিক আন্তর্জাতিক ক্যাথলিক সংবাদ মাধ্যম ইউনিয়ন অব ক্যাথলিক এশিয়ান নিউজে (UCAN) কর্মরত।
No comments:
Post a Comment