Photo: Piyas Biswas/ucanews.com |
ছেলেবেলাতেই মিতব্যয়ীতা ও সঞ্চয় শব্দযুগলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল; কিন্তু যতদূর মনে পড়ে হাইস্কুলে পড়ার আগে বোধহয় এসবের মানে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারি নি ।
খুব সম্ভবত ক্লাশ সেভেন/এইটের বইয়ে একটা চমৎকার শিক্ষণীয় গল্প ছিল- Mr. Ant and Mr. Grasshopper (মি. পিঁপড়া ও মি. ফড়িং) । পিঁপড়া ও ফড়িং দুজনে প্রতিবেশী, কিন্তু দুজনের চরিত্রে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি । পিঁপড়া খুবই পরিশ্রমী, মিতব্যয়ী ও দূরদর্শী, অন্যদিকে ফড়িং কুঁড়ের হদ্দ, বেহিসাবী ও ভবিষ্যতের ভাবনা-চিন্তাহীন । প্রতিদিন পিঁপড়া কঠোর পরিশ্রম করে খাদ্য জোগাড় করত আর ফড়িং মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াত, মাঝে মধ্যে পিঁপড়াকে তার সঙ্গে যোগ দিতে বলত, তার কথায় কান না দেয়ায় পিঁপড়াকে ‘বোকা’ ‘গাধা’ বলে গালমন্দ করতেও ছাড়ত না । শীতকাল সন্নিকট হলে পিঁপড়া শীতের খাদ্য সঞ্চয়ে তার কাজের মাত্রা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল, সে এমনকি ফড়িংকেও সে খাদ্য জোগাড়ের পরামর্শ দিল । কিন্তু ফড়িং তাতে কোন কান দিল না, সে আগের মতই গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াতে লাগল । সে বছর বেশ আগে-ভাগেই শীত পড়তে শুরু করল এবং ক্রমশই ভয়াবহ ঠান্ডা পড়ল । ফড়িংয়ের ঘরের খাদ্য দ্রুত নি:শ্বেষ হয়ে গেল, কারণ সে সময়মত তেমন কিছুই সঞ্চয় করে নি । ক্ষুধার্ত ও অবসন্ন অবস্থায় সে তখন পিঁপড়ার কাছে গেল খাবার চাইতে, কিন্তু পিঁপড়া তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি যে পরিমাণ খাদ্য মজুদ করেছি তা দিয়েই গোটা শীতকাল পার করতে হবে । তোমাকে খাবার দিলে শেষে আমাকেই না খেয়ে মরতে হবে ।” হতাশ ফড়িং ফিরে গেল, এবার তার আফসোস হতে লাগল ‘ইস! কেন যে সময়মত খাবার জোগাড় করে রাখলাম না?’ এসব ভাবতে ভাবতেই অনাহারে দুর্বল হয়ে একসময় ফড়িং মারা গেল ।
গল্পটির নৈতিক শিক্ষা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না । যে মানুষ সময় থাকতে সঞ্চয় করে না, যে ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবে না তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার । মিতব্যয়ীতা ও সঞ্চয়ী মনোভাব অনেকটাই এক অন্যের পরিপূরক । মিতব্যয়ীতা মানে কিপটেমি করা নয়, বরং হিসেব করে চলা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় না করা । গ্রামের মুরুব্বীদের মুখে আজও সেই উপদেশ বাণী শোনা যায়, “বেলা থাকতে হাইট্যা যাইও, খাওন থাকতে থুইয়্যা খাইও” অর্থাৎ হিসেব করে চল যেন দুর্দিনে সমস্যায় না পড় ।
আজ থেকে কয়েক দশক আগে শহর কিংবা গ্রামে বিত্তশালী ও অবস্থাপন্ন লোকের সংখ্যা ছিল কম । আজ সে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে । অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিকে মানুষ অনেকটাই স্বাবলম্বী হয়েছে । বিশেষত খ্রীস্টান সমাজে আজকাল নিতান্ত দরিদ্র, অনাহারে বা আধপেটা খেয়ে থাকে এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর । কীভাবে সেটা সম্ভব হল? এটা বহু বছর পূর্বে বিদেশী মিশনারীদের স্বপ্ন ও প্রয়াসের ফসল যার লক্ষ্য ছিল সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা ও তুলনামূলক দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করে তোলা । যার সুবাদেই বিভিন্ন খ্রীস্টান অধ্যুষিত জনপদে সঙ্গোপনে গড়ে উঠেছিল সমবায় আন্দোলন, যা কালক্রমে সমাজের আর্থ-সামাজিক ভাগ্যরেখা নিরুপণে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে । এ কৃতিত্বের দাবিদার আমাদের পূর্বসুরীরা যাদের দূরদর্শীতা, নেতৃত্ব ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের সুফল আজ আমরা ভোগ করছি ।
সমবায়ের মাধ্যমে সমাজের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের ধারণা এদেশে বয়ে নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ ফাদার চার্লস জে. ইয়াং সিএসসি ও তার সমসাময়িক ইউরোপীয় ও আমেরিকান মিশনারীরা । তার আগে এদেশের মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক সমবায় সমিতি সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা ছিল না, যদিও জার্মানিতে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ ধরণের সমবায় সমিতির যাত্রা শুরু । দুজন জার্মান সমাজসেবক হারম্যান শুলজ-ডিলিচ্ ও উইলহেলম রেফেইসেন যথাক্রমে ১৮৫২ ও ১৮৬৪ সালে অনেকটাই আজকের ক্রেডিট ইউনিয়নের আদলে সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন জার্মানিতে, যা উনিশ শতকের শেষার্ধে গোটা ইউরোপ ও আমেরিকায় বিস্তার লাভ করে । সমবায় আন্দোলনের দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জনের কারণ ছিল শিল্প বিপ্লবের ফলে ধনাঢ্য শ্রেণীর কাছে অবহেলিত ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুবিধা নিতে অপারগ পেশাদার, মধ্যবিত্ত ও তুলনামূলক দরিদ্র শ্রেণীর কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা । এ ব্যবস্থার ফলে প্রায় সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের অভাবনীয় সুযোগ সৃষ্টি হল । একবিংশ শতকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বদৌলতে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যাওয়া ইউরোপ বা আমেরিকায় বর্তমানে সমবায় আন্দোলন অনেকটা নেই বললেই চলে । কিন্তু পৃথিবীর অনগ্রসর অংশ, বিশেষত বাংলাদেশের ন্যায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সমবায় আন্দোলন আজও প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ ।
যেকোন প্রতিষ্ঠান বা সমিতির সাফল্যের নিয়ামক তার নেতৃবর্গ ও সদস্যদের আন্তরিকতা, সততা ও উদারনৈতিক মনোভাব । একথা বলার অপেক্ষা রাখে না- মানুষ তার সমন্বিত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয়, আবার সেই প্রতিষ্ঠানই আবার মানুষকে গড়ে তোলে । মানুষের ভালবাসা প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখে, আবার সেই মানুষের অপকর্মে তিলে তিলে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যায় । সমবায় সমিতির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য ।
সমিতির সদস্যদের যেমন দায়িত্ব নিয়ম মোতাবেক সঞ্চয়, ঋণ ও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করা, তেমনি সমিতির পরিচালকদের উচিত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করা । শুধু সঞ্চয় বা ঋণ নয়, সমিতির কার্যক্রম যথার্থভাবে পরিচালিত হচ্ছে কীনা সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা ও কার্যক্রমের গঠনমূলক সমালোচনা করা তাদের কর্তব্য । সময়ের পরিবর্তনে সমবায় আন্দোলন খ্রীস্টান সমাজের আর্থিক উন্নতিই শুধু সাধন করে নি, সমাজে নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছে যারা সমাজের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চাকাকে সচল রেখেছেন ।
একটি মুদ্রার যেমন দুটি দিক থাকে, চাঁদের যেমন কলংক আছে- তদ্রুপ আমাদের সমবায় সমিতিগুলোও কালিমামুক্ত নয় । আমার বিগত প্রায় এক দশকের সমবায় সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা থেকে দু:খের সাথে বলতে হয়, খ্রীস্টান সমাজের বিভিন্ন সমবায় সমিতির নেতৃত্ব ও সাধারণ সদস্য উভয়ই বহুলাংশে তাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব থেকে দূরে সরে গেছে । সমিতিগুলোর পরিচালনা পরিষদ নির্বাচনের সময় প্রায়শই যে পরিমাণ দলাদলি, কাদা ছোঁড়াছোঁড়ি ও অর্থ অপচয় হয় তা কোন অংশে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে কম নয় । এ দলাদলির রেশ অনেক সময়ই আদালত পর্যন্ত পৌঁছায়, একজন আরেকজনের আজীবন শত্রুতে পরিণত হয়। নেতাদের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অন্যায়ভাবে বিভিন্ন সুবিধা নেয়ার অভিযোগও শোনা যায় । প্রতি বছর সমিতি ব্যবস্থাপনার নামে, বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে বিপুল ব্যয় এবং সদস্যদের সুবিধার চেয়ে অসুবিধা সৃষ্টি করা হর-হামেশাই চলছে । সদস্যরাও কোন অংশে কম যান না । অনেক সদস্য ব্যক্তিগত প্রভাব কাটিয়ে, অনেক ক্ষেত্রে অন্যায়ভাবে বিরাট অংকের ঋণ নেন এবং পরে লাপাত্তা হয়ে যান । অনেকে আবার নিজের কাজ উদ্ধারের জন্য অন্যায় দেখেও না দেখার ভান করেন ।যার কারণে আজ প্রায় সকল সমিতিতেই খেলাপী ঋণের বোঝা জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে । যার মাশুল প্রতিনিয়ত দিতে হচ্ছে সৎ ও নিষ্ঠাবান সদস্যদেরকে । এমনটা কি হবার কথা ছিল? সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে যে মহামানবেরা আমাদের মুক্তির বাণী শোনালেন তাদেরকে কী অপমান আর অশ্রদ্ধাই না আমরা করলাম? খ্রীস্টান হিসেবে আমাদের আদর্শ ও স্বাতন্ত্র্য আজ কোথায়?
আজ আমাদের সমবায় সমিতিগুলোর অবনমন দেখে মনে পড়ছে আরেকটি শিক্ষণীয় গল্প- একটি বানর ও দুটি ইঁদুর । একবার দুই বন্ধু ইঁদুর খাবার খুঁজতে গিয়ে এক টুকরো কেক পেল । কীভাবে এক টুকরো কেক সমান দুই ভাগে বন্টন করা যায় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে তারা দুজনে গেল এক বানরের কাছে । বানর তাদের দুজনের সমস্যার কথা শুনে দাঁড়িপাল্লা বের করল ও কেকটাকে ভেঙ্গে দু’ভাগ করে ওজন মাপতে লাগল । কিন্তু সমানভাবে ভাঙ্গা না হওয়ায় একপাশে ওজন বেশি অন্যপাশে কম হল । বানরের মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল, সে বড় টুকরোটায় এক কামড় খেয়ে নিয়ে আবার ওজন দিতে বসল । কিন্তু এবারে অন্য টুকরোটি ওজনে বেশি হল এবং বানর আবার আরেক কামড় খেয়ে ওজন সমান করার চেষ্টা করল । বারবার সে একই কাজ করতে গিয়ে এক সময় গোটা কেকখানাই তার পেটে চালান করে দিল । এদিকে বানরের কারসাজিতে বোকা বনে দুই ইঁদুর যুগপৎ বিস্মিত ও হতাশ হয়ে ফিরে গেল ।
মানব জীবনে যেমন চড়াই-উৎরাই আছে, প্রতিষ্ঠানেরও সুসময় ও দু:সময় যায় । আজকের অমানিশার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমি মর্মাহত, কিন্তু আশাহত নই । জীবনে আশাবাদী না হলে সুখ-শান্তির দেখা মেলে না । আর তাই আমি সেই সোনালী ভোরের প্রতীক্ষায় আছি, যখন সমবায়ী নেতৃত্ব ও সদস্যদের মনোভাব ও স্বভাবে গুণগত পরিবর্তন আসবে, নতুন প্রজন্মের হাত ধরে সমাজের কাঙ্খিত উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব হবে । সুরঙ্গের শেষে সেই সোনালী আলোকরেখার জন্য অপেক্ষার প্রহর যত সংক্ষিপ্ত হবে, ততই তা সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য কল্যাণকর ।
Click here to read the article on BD Christian News published on Jan. 15, 2018
No comments:
Post a Comment