Jan 25, 2018

ন্যায্যতা, মানবাধিকার ও শান্তি


Justice, Human Rights and Peace. Photo: Justice and Peace Foundation, Archdiocese of Kingston, Canada

সমাজে বসবাসকারী সকল মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের সাথে ন্যায্যতা, মানবাধিকার ও শান্তি নিবিড়ভাবে জড়িত। সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যদিও সবাই সমানভাবে জন্মগ্রহণ করে না, তথাপি মানব মর্যাদার দিক থেকে সকলেই সমান অধিকার লাভের যোগ্য। “যা সিজারের তা সিজারকেই দাও! আর যা ঈশ্বরের, তা ঈশ্বরকেই দাও (মথি ২২:২১)।” মানবপ্রেমী যীশুখ্রীষ্টের এই অসাধারণ বাণীর মাঝেই ন্যায্যতা ও মানবাধিকার সংক্রান্ত সকল প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে। ন্যায্যতা মানে হলো ব্যক্তি মানুষের মর্যাদা দেওয়া এবং তার মানবাধিকার মৌলিক অধিকারের প্রতি ন্যায়ানুগ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা। অর্থাৎ সহজ কথায়, যার যা প্রাপ্য তা তাকে প্রদান করাই হচ্ছে ন্যায্যতা।


ব্যক্তি জীবন হতে শুরু করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে মানব মর্যাদার এই প্রাপ্য স্বীকৃতিই মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত। জগৎ ও জীবনের বিস্তীর্ণ লীলাভূমিতে মানব উন্নয়ন ও মানব মর্যাদা সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা ও মানবাধিকার সর্বদা সহায়ক ভূমিকা পালন করে এসেছে। ন্যায্যতা ও মানবাধিকার রক্ষার অনিবার্য পরিণতিতে শান্তির পরম প্রসাদ লাভ করা যায়। কেননা “শান্তি হচ্ছে ন্যায্যতার কাজ এবং ভালবাসার ফসল (ইসাইয়া ৩২:১৭)।” যেখানে মানুষে মানুষে ও জাতিতে জাতিতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভ্রাতৃসুলভ মূল্যবোধের চর্চা হয়, সেখানেই অজস্র প্রতিকূলতাকে ডিঙ্গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যায্যতা ও মানবাধিকার আর শান্তির সুবাতাস জীবনকে পুলকিত করে তোলে।

মানব সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই মানুষ পরস্পরের প্রতি ন্যায্য আচরণ তথা মানব মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার তাগিদ অনুভব করে আসছে। কালের বিবর্তন চক্রে আধুনিক যুগের মানুষের মাঝেও মানবীয় বোধের পর্যায়ক্রমিক বিকাশ ঘটেছে, আরো জোরালো হয়েছে মানবিক অধিকার তত্বাবধান ও রক্ষার আবেদন। কিন্তু সমগ্র বিশ্বের চালচিত্রের উপর একটু নজর বুলিয়ে হতাশার সুরে বলতে হয়, আজো পৃধিবীতে তিন-চতুর্থাংশ মানুষ তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকৃষের এই যুগে সভ্যতার সুফল ভোগ করছে স্বৈরাচারী মনোবৃত্তিসম্পন্ন একদল মানুষ, যাদের সর্বগ্রাসী লোলুপতার লেলিহান জিহ্বা গ্রাস করে চলেছে সারা বিশ্বের মোট সম্পদের সিংহভাগ। এদের শোষণ ও পেষণে প্রতিনিয়ত লংঘিত হচ্ছে অসহায় মানুষের মানবীয় চাহিদা ও অধিকার। ফরাসী বিপ্লবের পুরোধা দার্শনিক রুশো যথার্থই বলেছেন, “মানুষের কারণেই মানুষ আজ সবচেয়ে বেশি অবহেলা, নিপীড়ন, নির্যাতন ও বৈষ্যম্যের শিকার”।

তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশসমহে বিশেষ করে, বাংলাদেশ ন্যায্যতা ও মানবাধিকার লংঘনের সমস্যাটি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সুশীল সমাজ তথা সচেতন মহলে এ নিয়ে উদ্বেগ ও শংকা দেখা দিলেও দেশের হর্তাকর্তাদের এ নিয়ে কোন মাথাব্যথাই নেই! নির্যাতন, অত্যাচার ও অন্যায্যতার যুপকাষ্ঠে বলির শিকার অসহায় মানুষ আজ তাদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ে সোচ্চার। দেখা যাচ্ছে সুবিধাভোগী ও বঞ্চিত শ্রেণীর মধ্যে সুদূরপ্রসারী সংঘর্ষের সম্ভাবনা। ফলে মানুষের শান্তি আজ হুমকির সম্মুখীন। সুতরাং ন্যায্যতা ও মানবাধিকার সংরক্ষণ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা আজ অত্যন্ত জরুরী ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালবাসা ও ভ্রাতৃপ্রেমের সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা যদি আমাদের অভিপ্রায় হয়, তবে আমাদেরকে মানব জাতির মুক্তিদাতা যীশু খ্রীষ্টের শরণাপন্ন হতে হবে। কেননা খ্রীষ্টই হলেন সকল মানুষের রক্ষক, তাঁর প্রচারিত মূল্যবোধই পারে আজকের পতনোম্মুখ বিশ্বকে ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করতে। ন্যায্যতা, মানবাধিকার ও শান্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক ঘোষণা বা দলিলপত্রে যতই বিভিন্ন বিধান লিপিবদ্ধ থাকুক না কেন, খ্রীষ্টীয় মূল্যবোধই হচ্ছে এসবের সারকথা। খাঁটি খ্রীষ্টীয় ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধের যথার্থ অনুশীলনই হচ্ছে মানুষের মাঝে একই সময়ে সবচেয়ে সুন্দর সমতা এবং সবচেয়ে নিখুঁত ন্যায্যতার প্রকাশ।

ব্যক্তি মানুষ নানা ধাপ অতিক্রম করে পর্যায়ক্রমে জীবনের সকল লেনদেন সম্পন্ন করার প্রয়াস চালায়। আর তাই স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ন্যায্যতা, মানবাধিকা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ও প্রক্রিয়ায় তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। ক্ষেত্রভেদে মানব মর্যাদা ও মানব উন্নয়নের ধারা স্বাভাবতই বহুমূখী এবং বৈচিত্র্যময়।

পরিবার : জীবন মানুষের জন্য ঈশ্বরের এক বিষ্ময়কর দান। আর পরিবার হচ্ছে ভালাবাসার এক প্রাণময় ফল্গুধারা ও জীবন চেতনার কল্যাণমূখী গতি প্রবাহের উৎস। পারস্পিরিক প্রেম-প্রীতি এবং সহযোগিতা সহমর্মিতায় পৃথিবীতে সুখের স্বর্গ রচনায় আশা-ভরসার নীড়। বলা হয়, (Charity begins at home)। অর্থাৎ পরিবার থেকেই ভালবাসার সূত্রপাত হয়। মানবীয় গুণাবলীর শ্বাশত শিক্ষালয় হিসেবে একটি শিশুকে স্নেহ মমতার বন্ধনে জড়িয়ে উপযুক্ত শিক্ষা দান করে তাকে ভবিষ্যৎ জীবনে মানবতাবাদী হবার সোপানে পৌঁছে দেবার প্রাথমিক দায়িত্ব পরিবারের উপরই ন্যস্ত রয়েছে। কিন্তু হায়, আমাদের পরিবার ব্যবস্থার সাম্প্রতিক হালচাল অবলোকন করে এমনটি প্রত্যাশা করা রীতিমতো অসঙ্গত বলেই মনে হয়। পরিবার প্রথা ও পরিবারিক ভালবাসার ঐতিহ্য নিয়ে যে গর্বভরা অংশীদারিত্ব আমাদের ছিলো, তা আজ বহুলাংশেই ক্ষুন্ন হতে চলেছে। পরিবারে পিতামাতার মধ্যে অত্যধিক ব্যস্ততার ভাব, স্বার্থান্বেষী মনোভাব, অসহযোগিতা, ভুল বোঝাবুঝি, গর্ভপাতের অনুশীলন, ব্যভিচার, ক্ষমাহীনতা প্রভৃতি পরিবার ব্যবস্থার ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করেছে। আবার অন্যদিকে প্রবীণ পিতা-মাতার প্রতি অবহেলা, নারীদের উপর পুরুষের প্রভুত্ব করার প্রবণতা সর্বনাশা ব্যধির মত বাসা বেঁধেছে পরিবারের বুকে। ফলশ্রুতিতে দাম্পত্য কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ ও আত্মহনন ইত্যাদি সমস্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পারিবারিক অন্যায্যতার মাঝে যে শিশুরা বেড়ে উঠছে, তারা আদৌ কী অদূর ভবিষ্যতে মানবীয় গুণসম্পন্ন ও শান্তির রক্ষক হতে পারবে?

ভাঙন ধরা পরিবার ব্যবস্থাকে পূর্বেকার ঐতিহ্যে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই পরিবারে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সহযোগিতা-সহমর্মিতার মূল্যবোধ পুনর্গঠন সকলের প্রাপ্য অধিকারের প্রতি ন্যায্য দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী। একথা ভুলে গেলে চলবে না, সকলেই এক ও অভিন্ন প্রতিমূর্তিতে সৃষ্ট হয়েছে। মানবীয় দুর্বলতা থাকা সত্বেও স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য ভালবাসা, পারস্পরিক বিশ্বাস রক্ষা পারিবারিক যোগবন্ধনকে সমুন্নত রাখতে সক্ষম। কার্যত, ন্যায্যতা ও শান্তির আবাসরূপে বিবেচিত পরিবার খ্রীষ্টীয় মূল্যবোধের যথার্থ অনুশীলন করে এবং সেই পরিবারের উত্তরসূরিরাও মানবতার প্রকৃত রক্ষক হয়ে উঠে।

সমাজ কাঠমো : নানারূপ পারস্পরিক সম্বন্ধের জটিল জাল হচ্ছে সমাজ। মানুষ সমাজে জন্মগ্রহণ করে, লালিত-পালিত হয় এবং সকল কর্মলীলা সাঙ্গ করে একদিন সেখানেই মৃত্যবরণ করে। জীবদ্দশায় ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতির সাথে সামঞ্জস্য বিধানের লক্ষ্যে মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধন এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদান, সেবা-ভ্রাতৃত্বপূর্ণ মনোচেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া ও কাজ করা অতীব দরকার। অথচ বড়ই আক্ষেপের ব্যাপার এই যে, আমাদের চেতনা, শিক্ষা ও আদর্শ আজ আর মানুষের মানুষে ভেদাভেদহীন মূল্যবোধের জয়গান গেয়ে উঠে না। সত্যে সুদৃঢ়, ন্যাত্যতায় প্রতিষ্ঠিত ও প্রেমে লালিত ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্দীপিত হয়ে আমি বলতে পারি না, “আমার ভাই, আমার দায়িত্ব”। বিরাজমান সামাজিক বাস্তবতা হচ্ছে মানুষে মানুষে শ্রেণী বিভাজন, ধনী-গরীবের মধ্যে পর্বত সমান পার্থক্য, ক্ষমতার দম্ভ প্রর্দশন, ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে মানুষের অবমূল্যায়ন, সাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং অপসংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান চর্চা দ্বারা মানুষের মৌল-মানবীয় অধিকার খর্ব করা এবং মানব উন্নয়নের দ্বার রুদ্ধ করে দেয়া। সামাজিক অন্যায্যতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। প্রতি মুহূর্তে যেখানে মানবতা ভূলুণ্ঠিত ও পদদলিত হয়ে চলেছে অতি নগন্য সংখ্যক অপশক্তির প্রভাবে এবং সাধারণ মানুষও এতে করে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। অথচ সমাজে আজো ভালো মানুষ, সৎ মানুষের উপস্থিতি রয়েছে। যারা স্বপ্ন দেখে সুন্দর ও সুখী সমাজ ব্যবস্থায় জীবন নির্বাহ করার। সবকিছু জেনে শুনেও তারা মূক বধিরের ভূমিকায় অবতীর্ন হয়। কেননা দেশে প্রচলিত সামাজিক আইন মানুষের যথার্থ নিরাপত্তা বিধানে অপারগ। প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো আইনের মারপ্যাচে নাজেহাল হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আর তাই জনজীবনে অন্যায্যতা ও অশান্তির বিষবাষ্প ছড়িয়ে অপরিমেয় অনিষ্ট সাধনকারী ঘৃণ্য কীটের দল বহাল তবিয়তে আইনের ফাঁকফোকর গলে তাদের কর্ম-কর্তব্য (!) সম্পাদন করে যায়। পুরুষশাসিত সমাজ কাঠামোতে বেড়ে উঠা অধিকাংশ পুরুষ সহজাত চিন্তা চেতনার বলে ধরে নেয়, নারী অধিকারকে খর্ব করা তাদের জন্মগত অধিকার। সে কারণে শাসনের নামে নারীদের উপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। উন্নত বিশ্বে পুরুষ ও নারী সমান মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করেও এদেশের প্রক্ষাপটে তার বাস্তবায়ন আজো সুদূরপরাহত। এ সমস্যার একটি মাত্র সমাধান সমগ্র চালচিত্র বদলে দিতে পারে। ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্ট মানুষ হিসেবে নারী জাতির সমঅধিকার  ও সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে মূল্যায়ন দ্বারা এ বৈষম্যের মূলোৎপাটন সম্ভব।

সমাজের অসহায় ও দুর্বল শ্রেণীর মানুষের উপর দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অন্যায্যতার স্টিম রোলার চালিয়ে যারা বড় হবার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করে সম্মিলিত উদ্যোগে তাদের প্রতিহত করতে হবে। বৃহত্তর ঐক্য প্রচেষ্টায় শামিল হতে গিয়ে মনে রাখা উচিত, সমাজকে ন্যায্য ও মানবীয় করে তুলতে হলে মানুষের জন্য আমার অনেক কিছু করার ও ভাবার আছে।   উদাসীন হয়ে থাকার অর্থ অন্য যাই হোক, প্রকৃত সৎ মানুষের পরিচয় নয়। “আমার তুচ্ছতম ভাইদের একজনের জন্যে তুমি যা করেছ, তা আমারই জন্য করেছ” (মথি ২৫:২০)। যীশুর এই মূল্যবোধ সমাজে ন্যায্যতা ও মানব মর্যাদা রক্ষা করে শান্তি স্থাপনে আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস।

রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডল : জন্মগতভাবেই মানুষ বৃহৎ রাজনৈতিক সমাজ বা রাষ্ট্রের সদস্য হয়ে উঠে। অধিকার ও কর্তব্যের মাপকাঠিতে জনগণ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের পালনীয় বিধি বিধান বন্টন করা হয়ে থাকে। আধুনিক রাষ্ট্রীয় কাঠমোতে সনাতন ব্যবস্থাপনার ব্যাপক পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন সাধিত হয়েছে। তথাপি পৃথিবীর কতিপয় রাষ্ট্র ব্যতীত সর্বত্রই সাধারণ জনগণ রাজনৈতিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন ও শোষণের শিকার। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয়ভাবে জনগণের মৌল-মানবিক অধিকার ক্ষুন্ন করার সমস্যা এক কথায় ভয়াবহ রকমের। তদনুক্রমে, আমাদের দেশের চলমান অস্থিতিশীল অবস্থা ও অসুস্থ রাজনীতির চর্চা প্রতিনিয়ত জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নেই। ঘর থেকে বাইরে বেরুবার সময় কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে না সে পুনরায় অক্ষত হয়ে ঘরে ফিরতে পারবে কিনা। চারদিকে সীমাহীন দুুনীর্তি, সন্ত্রাসের রাজত্ব, উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদের মাথাচাড়া, স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের সদম্ভ পদচারণা, প্রশাসনে নিলর্জ্জ স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ অব্যাহত ধারায় চলছেই। তাছাড়া মরার উপর খাঁড়ার থায়ের মত নজিরবীহিন রাজনৈতিক কাদা ছোঁড়াছুড়ি তো আছেই অজস্র আইন থাকলেও তার সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই। আইনের রক্ষকরাই আজ ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছে। আইনের ছত্রছায়ায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আদলে বিভিন্ন বাহিনী ব্যবহুত হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের শায়েস্তা করার কাজে। দ্রব্যমূলের পাগলা ঘোড়া উর্ধ্বশ্বাসে ছুটেই চলছে- বাগ মানছে না, দেশজুড়ে আতংকে সৃষ্টিকারী বোমা হামলা ও অস্ত্রের ঝনঝনানিতে রক্তগঙ্গা বয়ে চলেছে, ধর্মের নামে ব্যবসা করে মানুষকে সাম্প্রদায়িক করার পায়তারা করছে একদল কুচক্রী ধর্মব্যবসায়ী। অবাক হবার বিষয়, দেশের সরকার এর থেকে ফায়দা লোটার কৌশল উদ্ভাবনেই মত্ত। স্বাধীনতা পরবতী সময়ে বার বার সরকার পরিবর্তন হলেও সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে বরং অবনমন ঘটেছে। আজকে রাজনৈতিক মুক্তি ও প্রয়োজনের চেয়ে ক্ষমতা বা পেশীশক্তি প্রদর্শনই মুখ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণের সমর্থন আদায়ে অজস্র প্রতিশ্রতির ফুলঝুড়ি ছোটান, জনগণকে উন্নয়নের মর্তমান মূলো দেখান।  অথচ ক্ষমতা লাভের পর তারাই বহুরূপীর মত জনগণের ঘাড়ে সাওয়ার হয়ে তাদের সর্বস্ব হর করেন। ঠিক  যেন, লংকায় যে যায়, সেই রাবণ হয়’ দশা। রাষ্ট্রীয় আইন-শৃংঘলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো এসব নেতাদের প্রত্যক্ষ মদদ যোগায় নীতিহীনতার দ্বারা মানবতার টুঁটি চেপে ধরতে।

আমাদের দেশে মানবতার অপমানে মানবের মাঝে উপস্থিত মানবপ্রেমী যীশু প্রতিনিয়ত আর্তনাদ করে বলে উঠেন, “শৌল শৌল, কেন তুমি আমাকে নির্যাতন করছো? (শিষ্যচরিত ৯:৪)” । কিন্তু তা শুনেও না শোনার ভান করছি। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রকৃত অর্থে সর্বক্ষেত্রে ন্যায্যতা, শান্তি ও মানব মর্যাদা সম্মুন্নত রাখতে হলে তার দৌঁড় শুরু করতে হবে পরিবার ও সমাজ থেকে পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয় পরিসরে। অনেক সময় আমরা বেশি নজর রাখি রাষ্ট্র কেমনভাবে ন্যায্যতা ও মানবাধিকার লংঘন করে, কিন্তু বেশি নজর রাখি না যখন দৈনন্দিন জীবনের নানা ক্ষেত্রে আমরাই ভ্রাতৃত্ব, সমতা ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছোটখাট কাজ করি। ছোট ছোট ক্রিয়া মানুষের গঠনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদের প্রতি সম্মান জাগে এই গভীর চেতনা থেকে যে, ঈশ্বরের সামনে মানুষ সবাই সমান। “তুমি তোমার প্রতিবেশীকে আত্মতুল্য প্রীতি করবে” অর্থাৎ অন্যের প্রতি সেরূপ ব্যবহারই কর যা তুমি অন্যের কাছ থেকে আশা কর। যীশুর এই অমর বাণী হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের ন্যায় অনুন্নত দেশসমূহের মৌলিক পট পরিবর্তনের মাইলফলক।

আন্তর্জাতিক বলয় : মানব জাতি দিনের পর দিন এই বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হচ্ছে যে, তা ক্রমেই একটি বৃহৎ পরিবারের মত গঠিত হচ্ছে। যার উন্নতি স্থায়ী হয়। যখন প্রত্যেকজন মানুষের অধিকার ও সম্মান রক্ষা পায়। আধুনিক রাষ্টসমূহের সংবিধান লক্ষ্য রাখে যেন, মানুষের যোগ্য সমাজ গঠন করার উদ্দেশ্যে কয়েকটি মানবাধিকার ভিত্তি স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। মানব সম্প্রদায়ের প্রতিটি সদস্যের জন্মগতভাবে পাওয়া স্বকীয় ও মানবাধিকারের স্বীকৃতি নিহিত রয়েছে তার মুক্তি, সুবিচার ও শান্তির নিশ্চয়তার মধ্যে। দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে, ১৭৭৯ খ্রীষ্টাব্দে সংঘটিত ফরাসী বিপ্লব থেকে মানুষ ও নাগরিকের মানবাধিবার সংক্রান্ত যে মূল্যবোধের জন্ম হয়েছিলো, অশান্ত আন্তর্জাতিক পরিম-লে তা ক্রমেই ক্ষয়িঞ্চু রূপ ধারণ করেছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ন্যায্যতা ও মানবাধিকারের প্রতি আনুগত্যহীনতা ও অশ্রদ্ধা থেকে মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে ও রাষ্টপুঞ্জে বৈষম্য ও সংঘাতময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান বিশ্ব পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকি ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সম্মুখীন।

২০০১ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে বর্বর সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ধরনের ব্যাপক রদবদল এসেছে। বিশ্বের একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চরম সাম্রাজ্যবাদী নীতি, পশ্চিমা পুঁজিবাদ তথা মুক্তবাজার অর্থনীতির খোলসে নব্য অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধূয়ো তুলে আফগানিস্থন ও ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসন, ইসলামী জঙ্গীবাদের ভয়াবহ উত্থান, ইসরাইল ফিলিস্তিন সংকট প্রভৃতি শান্তিকামী মানুষের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করেছে। যুদ্ধ বা হামলা চালিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ কখনোই সফল হবার নয়। বরং মানব মর্যাদার অবমাননা করা হয় আগ্রাসনের বীভৎস রূপে। খাদ্যাভাবে ক্ষুধার সঙ্গে সঙ্গে লড়াই করে হাজারো মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়, অথচ পরাক্রমশালী বিশ্ব নেতৃবৃন্দ মানব সভ্যতার প্রতি হুমকিস্বরূপ নানাবিধ মরণাস্ত্র নির্মাণে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢালছে। বিশ্বের মোট সম্পদের সুষম বন্টন না করে অপচয় করা হচ্ছে অর্থলিপ্সা ও বাণিজ্যিক স্বার্থ চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে। ধনী দেশসমূহে পুষ্টিমান ও স্বাস্থ্যগত উন্নতি হচ্ছে। অন্যদিকে দরিদ্র দেশসমূহে মানুষ সহায় সম্বলহীন অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে। মানব সমাজের বিরাট অংশকে বঞ্চিত রেখে ধনাঢ্য দেশগুলো জীবনমান অক্ষুন্ন রাখার নাম করে আত্মসাৎ করে চলেছে জ্বালানী ও কাঁচামালের সংহভাগ। দুটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সার্বজনীন ন্যায্যতা ও মানবাধিকার সম্মুন্নত রাখার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেননি। মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহাদ্যের অভাবে বিশ্ব আজ বিবাদে বিভক্ত। এই পরিস্থিতির আশু প্রতিকার করতে না পারলে মানব সভ্যতাকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে ঠেকানো যাবে না।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্বে শান্তিময় পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষে জাতিসংঘের নেতৃতে রাষ্ট্রপুঞ্জের সকল সদস্যকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়েছে, “মানব পরিবারের সকল সদস্যের সহজাত মর্যাদা ও সম অবিচ্ছেদ্য অধিকারসমূহের স্বীকৃতি বিশ্বে স্বধীনতা, ন্যাবিচার ও শান্তির ভিত্তি”। খ্রীষ্টীয় মূল্যবোধের উপর গ্রথিত এই মূলনীতির যথার্থ বাস্তবায়নে জাতিসমূহের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করা অত্যাবশ্যক। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উচিত সার্বজনীন মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে ন্যায্যভাবে মানুষের কল্যাণ, অগ্রগতি তথা সামগ্রিক উন্নয়নের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। আপন আপন ঐশ্বর্য ও স্বাধীনতার সুখে তৃপ্ত ও উদাসীন না থেকে মানব মর্যাদা ও মানব উন্নয়নের ধারণায় বিকাশ সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রতিটি দেশের প্রত্যেকজন মানুষের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব।

আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র বিশ্বে মানব মর্যাদা ও অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত কতে হলে সদিচ্ছা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহাদ্যপূর্ণ সহযোগিতার কোন বিকল্প নেই। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে ন্যায্যতা, মানবাধিকার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে বিশ্বমানবতার ঐকান্তিক বাসনা পূরণ করা সম্ভব। খ্রীষ্টীয় মূল্যবোধের যথার্থ অনুশীলন করে আজকের পৃথিবীতে এক নতুন সভ্যতার জন্ম দিতে হবে। যখানে পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা এবং ঈশ্বরের সাদৃশ্যে সৃষ্ট প্রত্যেক মানুষের মৌলিক মর্যাদা, ন্যায্যতা ও শান্তির আস্বাদ জীবনকে স্নিগ্ধতার পরশে দোলায়িত করবে। সেখানে মানুষের মধ্যে বির্তক বা যুদ্ধ দ্বারা নয়, বরং শ্রদ্ধাপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে মানবতার সাথে জড়িত সকল সমস্যার প্রত্যাশিত সমাধান টানা যাবে॥



No comments:

Post a Comment

দক্ষিণ এশিয়ায় ভোটের রাজনীতি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়

Bangladeshi Christians who account for less than half percent of some 165 million inhabitants in the country pray during an Easter Mass in D...