নভেল করোনা ভাইরাসের ভয়ংকর থাবায় দেশ হতে দেশান্তরে জনজীবন আজ পর্যুদস্ত। এ মহামারী আজ বিশ্বব্যাপী সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অঙ্গনসহ জগত ও জীবনের সকল ক্ষেত্রকে উলট-পালট করে দিয়েছে, সর্বত্র আজ দীর্ঘ লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব অবলম্বন করে জীবন বাঁচানো মরিয়া প্রয়াস চালানো হচ্ছে।
কতিপয় ধর্মীয় নেতা ও নীতিবাদীগণ এ মহামারী ও তার ভয়ংকর প্রভাবকে মানব সমাজের সুদীর্ঘকালের "পরিবেশতগত পাপের" বিরুদ্ধে "প্রকৃতির প্রতিশোধ" হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
অল্প বা অধিকমাত্রায় যাই হোক না কেন আমরা সকলে পাপী বটে, কারণ আমরা ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিজেদের মধ্যে বহুকাল ধরে নানা ধরণের ভাইরাসকে লালন করেছি। সেসব ভাইরাস কোনভাবে করোনা ভাইরাসের চেয়ে কম ভয়াবহ নয় এবং এ মহামারীকালে যখন গোটা পৃথিবী প্রাণ বাঁচাতে আর্তনাদ করছে, সে সময়েও এসব ভাইরাস দোর্দণ্ড প্রতাপে তাদের স্বরুপ দেখিয়ে চলেছে।
করোনা ভাইরাসের সঙ্গে এসব ভাইরাসের একমাত্র পার্থক্য হলো এটি কোন শ্রেণী ভোদাভেদ করে না। ধনী ও গরীব, ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও জাতির প্রতি করোনা ভাইরাস সমতার নীতিতে চরমভাবে বিশ্বাসী।
আজ আমরা যখন প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে নিজেদেরকে গৃহবন্দী করে রাখছি, আমাদের মনে রাখা উচিত যে যুগ যুগ ধরে আমরা নানা বন্য প্রাণী ও পাখিকে নিজেদের বন্য আনন্দের আশ মেটাতে খাঁচায় বন্দী করে রেখেছি। আসুন পেছন ফিরে দেখি আমাদের কী কী পাপের কারণে ক্রুদ্ধ প্রকৃতি আজ চরম প্রতিশোধ নিচ্ছে।
চীনের নৈতিক দেউলিয়াত্ব
যুগ যুগ ধরে চরম সমাজতন্ত্রী চীন খুব দক্ষতার সাথে মানবাধিকার ও ধর্মকে মারাত্নকভাবে পায়ের তলায় দলে এসেছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও বিরুদ্ধ মতকে ভয়ংকরভাবে স্বব্ধ করেছে এবং চীনের মূল ভূখন্ড ও হংকংয়ের মধ্যে বিশেষ স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলে গণতন্ত্রের সামান্যতম আকাংখাকে পিষে ফেলেছে।
চীনের সাম্প্রতিককালের ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও চীনের সাথে লাভজনক বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষার খাতিরে বিশ্বের তাবৎ প্রভাবশালী দেশগুলো চীনের এসব সর্বগ্রাসী ও নির্মম রাষ্ট্রীয় নীতি বন্ধ করতে কোন কার্যকর কোন উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
চীনের এহেন দমনমূলক ও হঠকারী রাষ্ট্রীয় নীতি সত্ত্বেও বোদ্ধারা ধারণা করেছিলেন একবিংশ শতক হতে চলেছে চীনা শতক। কিন্তু নির্মম পরিহাস হলো চীন অত্যন্ত লজ্জ্বাস্করভাবে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত সংবাদ প্রচার বাধাগ্রস্ত করা, এমনকি যে চিকিৎসক প্রথম এ ভাইরাস শনাক্ত করতে সক্ষম হন তাকে শাস্তির ব্যবস্থা প্রমাণ করে চীনকে কোনভাবে বিশ্বাস করা চলে না।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ দুরাচার ও দ্বিচারিতা বিশ্বজনীন এক মহাদুর্যোগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। এখন বিশ্বজুড়ে চীন ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন এবং আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার হুমকিতে পড়েছে। বাস্তবিক অর্থেই চীন এমন নৈতিকভাবে দেউলিয়া যে এক বৈশ্বিক পরাশক্তি হওয়ার কোন যোগ্যতা তার নেই।
রোম যখন পুঁড়ছে নিরো বাজায় বাঁশি
উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বিত্তশালী রাষ্ট্রগুলো করোনা ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ ও মৃত্যুর দিকে লক্ষ্য করলে ব্যাপারটি আরেকটু খোলাসা হবে।
ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের প্রতি নজর দিলে বোঝা যাবে তারা তাদের উন্নত বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে এতই আত্মতুষ্ট ছিল যে তারা আসন্ন এক মানবিক মহাবিপর্যয়ের সতর্কবাণীকে পাত্তাই দেন নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার বিপর্যরকর ও হঠকারী বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কার্যক্রম দেশটিকে করোনা ভাইরাসের সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যুর মাধ্যমে এক শোকরাজ্যে পরিণত করার পেছনে দায়ী।
ট্রাম্প ও তার তাঁবেদারগণ নানাবিধ ভুল পদক্ষেপের কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো সমালোচনার মুখে নিজেদের শোধরানোর পরিবর্তে ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কঠোর সমালোচনা করেন। তার ভাষায়, সংস্থাটি করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় "চরম অব্যবস্থাপনার" পরিচয় দিয়েছে এবং দাবি করেন যে সংস্থাটির "ভুল পদক্ষেপের কারণে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে।"
শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প এ চরম দুর্যোগকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মার্কিন সহায়তা স্থগিত করে দেন। ব্যাপারটি হতাশাজনক হলেও বিস্ময়কর নয়। যে লোক মনে করে জলবায়ু পরিবর্তন এক চীনা ষড়যন্ত্র, তার কাছ থেকে এমন আচরণ মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়।
ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো বরাবরই নিজেদেরকে সাম্যবাদের ধারক ও বাহক বলে প্রচার করে থাকে, কিন্তু বাস্তবে সত্যিকারের সাম্যবাদী ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা অনেক রাষ্ট্রে আজো সুদূরপরাহত। সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপে ক্রমবর্ধমান ডানপন্থী ও জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটেছে, যার ফলে বিভিন্ন রাষ্টে অভিবাসন ও শরণার্থীবিরোধী নীতি প্রণীত হয়েছে। এহেন দৃষ্টিভঙ্গি এ মহামারীর কালে আদতে কোন উপকারেই আসে নি। শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা ব্যবস্থা সত্ত্বেও হাজার হাজার নাগরিক মৃত্যুবরণ করেছে। যদি এ মহামারীতে এমনতর প্রাণহানি যদি একগুঁয়ে রাজনীতিকদের কঠিন হৃদয় পরিবর্তন করতে না পারে, তাহলে আর কোন কিছুতে হবে বলে মনে হয় না।
অবজ্ঞা, বৈষম্য ও দুর্নীতি
করোনা ভাইরাসের রাহুগ্রাসে যখন ভারত ও বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশে পড়ল, তখন অন্য সব সময়ের মতো বহুল পরিচিত ভাইরাস- অবজ্ঞা, বৈষম্য ও দুর্নীতি- অনিবার্যভাবে তাদের স্বরুপে আবির্ভুত হলো।
মার্চের ২৪ তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করলেন। তিনি তার দেশের কোটি কোটি হতদরিদ্র ও অভিবাসী শ্রমিক সম্প্রদায়ের দুর্দশার বিষয়ে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করলেন না। এমন তড়িৎ ও অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপের কারণে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র, অভিবাসী মানুষ শত শত মাইল পায়ে হেঁটে, খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে অনাহারে দু:সহ যাত্রা করে বাড়ির পথে।
ভারতীয় মিডিয়া জানায়, এ মহামারীকালে আসাম রাজ্যের বেশ কয়েকজন বিচারক কোভিড-১৯ ফান্ডে অর্থ সহায়তা করেন, তবে শর্ত হলো এ সহায়তা যাতে কোন মুসলিম না পায়। বিষয়টি দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচিত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের অসহিষ্ণু, বৈষম্যমূলক, দরিদ্রবিরোধী ও সংখ্যালঘুবিরোধী নীতির ফলে ভারতের যে উল্টোযাত্রা তা এ মহামারীতে আবারো প্রতীয়মান হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার এ মহামারীর ব্যাপার প্রাথমিকভাবে যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা ছিল অজ্ঞানতা ও শিথিলতাপূর্ণ। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সম্ভবত ধরে নিয়েছিলেন ভাইরাসটি এদেশে হানা দেয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও দরিদ্র দেশে করোনা ভাইরাস ভয়ংকররুপে আবির্ভুত হতে পারে, দেশে ও বিদেশে এমন সতর্কবাণী থাকা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেন নি। এমনকি ফেব্রুয়ারিতে স্বাস্থ্য বিভাগের তরফে জরুরী ভিত্তিতে মেডিকেল সামগ্রী আবেদন সত্ত্বেও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে নি।
সুতরাং, চীন ও অন্যান্য দেশে করোনা সংক্রমণে হাজারো মানুষ মারা যাওয়ার খবর সত্ত্বেও বাংলাদেশে জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক, এমনকি চীনের সঙ্গেও বিমান যোগাযোগ অক্ষুন্ন ছিল। স্কুল, ব্যবসাকেন্দ্র ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যথারীতি চলছিল। রাস্তাঘাট সর্বত্র জন ও যানে ছিল পরিপূর্ণ।
কোন কোন মূর্খ লোক এমন কথাও বলে বেড়াতে থাকলো যে করোনা ভাইরাস হলো চীনা লোকদের প্রতি অভিশাপ কারণ তারা নানা প্রকার নোংরা পশুপাখি খায়, সুতরাং বাংলাদেশের মতো মুসলিমপ্রধান দেশের ধর্মপ্রাণ লোকদের এ নিয়ে ভয়ের কোন কারণ নেই!
কিন্তু সবকিছুই বদলে গেল মার্চের ৮ তারিখ যখন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো তিনজন করোনা আক্রান্তের খবর জানা গেল, এবং পরিস্থিতি আরো ব্যাপকভাবে পাল্টাতে শুরু করল যখন এ ভাইরাসের কবলে ইউরোপ ও আমেরিকায় ব্যাপক প্রাণহানি শুরু হলো। দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা হলো, সমস্ত গণপরিবহন বন্ধ হয়ে গেলো এবং সকল প্রকার গণ জমায়েত নিষিদ্ধ করা হলো। শেষ পর্যন্ত সবই হলো তবে অনেক দেরিতে।
আজ অবধি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এক লাখেরও অধিক লোক করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এবং চৌদ্দ শতাধিক মারা গেছে। এ পর্যন্ত ৬ লাখের অধিক লোককে পরীক্ষা করা হয়েছে, যা এ বিপুল জনসংখ্যার দেশে তুলনামূলক কম। তাই আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুহারও কম। করোনার লক্ষণ নিয়ে অনেক রোগী ঘুরছে কিন্তু পরীক্ষা করে নি এবং মারা গেছে পরীক্ষা ছাড়াই, এমন সংখ্যা যে অনেক তা নিয়ে বেশকিছু জাতীয় মিডিয়া আশংকা প্রকাশ করেছে।
এহেন পরিস্থিতির পরেও বাংলাদেশী অনেক মানুষ চলাফেরা ও সমাবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা মানছে না, যার কারণে সরকার বাধ্য হয়ে পুলিশকে সহায়তা করতে সেনা মোতায়েন করতে বাধ্য হয়েছে। করোনার উপসর্গ নিয়ে বেশ কিছু রোগী বাড়ি ও হাসপাতাল থেকে পালিয়েও গেছে!
কোটি কোটি দরিদ্র ও কর্মহীন লোকদের জন্য সরকার নগদ অর্থ ও খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু বরাবরের মতো দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়েছে এখানেও। ডজন ডজন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা ও সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দরিদ্রদ্রের সহায়তার জন্য বরাদ্দ ২০০ টনের অধিক চাল আত্মসাৎ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
যে মহামারীকালে পারস্পরিক সহানুভূতির বড্ড প্রয়োজন, বাংলাদেশ ও ভারতে বাড়িওয়ালারা করোনা ভাইরাস সংক্রমণের অজুহাতে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বাসা ছাড়তে বাধ্য করেছে।
ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম ফাইনান্সিয়াল টাইমসে লেখা এক নিবন্ধে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন লিখেছেন যে তিনি আশা করেন যে করেন এ মহামারীর পর উন্নততর এক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, যেমনটা ঘটেছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর।
মোদ্দা কথা হলো, এ মহামারী শেষে বিশ্ব আরো নতুন ও উন্নততর রুপে আবির্ভুত হবে কি না তা অনেকাংশে নির্ভর করবে আমরা এ মহামারীর পূর্বে যেসব মন্দতা ও দুষ্টচক্রে বাঁধা পড়েছিলাম তা ত্যাগ করতে পারি কি না।
(মূল লেখা হতে ঈষৎ পরিমার্জিত)
©সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত©